চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পুরানো জাহাজের কোনো পণ্যই ফেলনা নয়

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:১৪ অপরাহ্ণ

সৌমিত্র চক্রবর্তী

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন মহাসড়কের মাদামবিবিরহাট এলাকায় অবস্থিত একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম এফএম এন্টারপ্রাইজ। জাহাজভাঙা শিল্পে আমদানিকৃত পুরোনো জাহাজ থেকে তামা, পিতল, এলুমিনিয়াম, পাখা, এসএস স্টিল প্রভৃতি সংগ্রহ করে পুনরায় বিদেশে রপ্তানি করে এ প্রতিষ্ঠান। বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এসব পণ্য রপ্তানি করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, চীনসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করে আসছে পুরোনো জাহাজের এসব সামগ্রী।

এতে একদিকে জাহাজভাঙা শিল্পে বাণিজ্যের প্রসার হচ্ছে, অন্যদিকে এসব ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারসহ স্থানীয় বহু যুবকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এ বিষয়ে কথা হয় এফএম এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান মো. মহসীনের সাথে। তিনি বলেন, ভাঙা বা কাটাকাটি থেকে পুরোনো জাহাজের উপরোক্ত মালামালগুলো নিলামে কিনে নিই। এরপর এসব মালামালগুলো প্রক্রিয়া করে পুনরায় বিদেশে রপ্তানি করছি আমরা। ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা আবার এখানে এসে আমাদের কাছ থেকে এসব পণ্য কিনে নেয়। তিনি বলেন, এগুলো ক্রয়ের ক্ষেত্রে দামের কোন ঠিক থাকে না।

যখন যেমন দাম পাই তখন তেমন দামে কিনে আনি। তবে গড়ে পিতলের দাম টনপ্রতি ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ, এসএস স্টিল ২-৩ লাখ, পাখা সাড়ে ৬ লাখ, এলুমিনিয়াম ১৫ লাখ, তামা ৭ লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়।

বার্ষিক প্রতিবছর গড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি মালামাল বিদেশে রপ্তানি করেন বলে জানান ব্যবসায়ী মো. মহসিন।

পুরোনো জাহাজ থেকে কোটি কোটি টাকার পণ্য কেনেন সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট জলিল এলাকার ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম। বিছমিল্লাহ আয়রন মার্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। তার প্রতিষ্ঠান জাহাজভাঙা শিল্পের স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে জেনারেটর, কম্প্রেসার, বয়লার, টার্বু চার্জার, লাইনার নামক বিভিন্ন যন্ত্র ক্রয় করে তা আবার দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে। বিছমিল্লাহ আয়রন মার্টের মালিক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে কেনা এসব যন্ত্রের মধ্যে প্রকারভেদ আছে। মানে ও গুণে পণ্যগুলো বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। জেনারেটরের দাম আছে ৩ লাখ থেকে ৩৫ লাখ টাকা দামের।

একটি কম্প্রেসারের দাম ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা, টার্বু চার্জার ১ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা, প্রতিটি লাইনার ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা দামেও বিক্রি হয়। ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম আরো বলেন, সীতাকু-ে জাহাজভাঙা শিল্পটি গড়ে উঠায় শুধু এ এলাকার মানুষই নয়, পুরো দেশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এমনকি আমাদের আশপাশের অনেক দেশও এই শিল্প থেকে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে এ ধরনের নানা যন্ত্রপাতি কিনে উপকৃত হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরোনো জাহাজে এসব যন্ত্র অল্প দামে বিক্রি হওয়ায় আমরাও অল্প দামে তা বিক্রি করতে পারি। এখানে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি না হলে যে জেনারেটর আমরা ৩০-৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি করি তা আমাদেরকে কোটি টাকার ওপরে কিনতে হতো। ফলে অন্য ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনে ব্যবসা করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তিনি বলেন, যদি জাহাজভাঙা শিল্প টিকে থাকে তাহলে এভাবেই দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

উপজেলার সলিমপুর, ফৌজদারহাট, ভাটিয়ারী ইউনিয়ন এলাকায় রফিকুল ইসলামের মতো আরো অন্তত ১৪-১৫ জন ব্যবসায়ী আছেন। যারা প্রতিবছর শত কোটি টাকার পণ্য স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে ক্রয়-বিক্রয় করেন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫০টির মতো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চালু আছে ৬০টির মতো ইয়ার্ড। এসব ইয়ার্ডে প্রতিবছর রেকর্ড পরিমাণ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি ও ভাঙা হয়। মূলত লোহার জোগান পেতে একসময় এই স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি শুরু হয়। পরে দেখা যায়, ভাঙা জাহাজ থেকে পাওয়া কোন পণ্যই ফেলনা নয়। স্ক্র্যাপ জাহাজগুলোতে আলপিন থেকে শুরু করে জেনারেটর, রান্নাঘরের তৈজসপত্র, ফার্নিচার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে শিল্পের কাঁচামাল পাওয়া যায়। স্ক্র্যাপ জাহাজের হাজারো পণ্যের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে সীতাকু-ের সলিমপুর, ভাটিয়ারী ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে। আবার এখান থেকে মালামাল সংগ্রহ করে নগরীতেও বড় বাজার গড়ে ওঠেছে। পাহাড়তলী, সিডিএ মার্কেট, সাগরিকাসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মার্কেট ও বিপণিকেন্দ্র রয়েছে। পুরোনো জাহাজের এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, জাহাজের প্রত্যেকটি সরঞ্জাম মজবুতভাবে তৈরি। সাগরের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে। সঙ্গত কারণে এসব পণ্য কেউ কিনে নিয়ে গেলে তিনি দীর্ঘকাল ব্যবহার করতে পারেন। ফলে এসব পণ্যের সুনাম রয়েছে দেশ-বিদেশে। ফলে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন এসব পণ্য পেতে। আর এভাবে পুরোনো জাহাজের পণ্যের বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে দেশ-বিদেশে। যা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল করেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য মতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে যত জাহাজ আমদানি হয়েছে, তার শুল্ক-করসহ আমদানি মূল্য ছিল ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। জাহাজের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় বাজারমূল্যও বেড়ে যায়। প্রতিটন লোহা বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৬০০ ডলারে। এ হিসাবে শুধু লোহা বিক্রির বাজারের আকার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার। আবার জাহাজের সরঞ্জামের বাজার দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এ দুইয়ে মিলিয়ে বাজারের আকার ১৫ হাজার কোটি টাকার। আমদানিকারক থেকে ব্যবহারকারী পর্যন্ত কয়েক দফা হাতবদল হয়ে বাজারের আকারও বড় হয়। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রি-সাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি শিল্পপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রতিবছর পুরোনো জাহাজ হিসেবে গড়ে ৩০ লাখ টনেরও বেশি স্ক্র্যাপ লোহা আমদানি করছি। এসব জাহাজ থেকে আবার হাজার রকম পণ্য পাওয়া যায়। ফলে এসব পণ্যের একটি বিশাল বাণিজ্য গড়ে উঠেছে দেশ-বিদেশে। শুধু ওই খাতেই বার্ষিক ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়ে থাকে। যা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করেছে।

লেখক:  নিজস্ব প্রতিনিধি, সীতাকুণ্ড

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট