চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

টেকসই শিল্পের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:০৬ অপরাহ্ণ

ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট অঞ্চলে বঙ্গপোসাগরের উপকূলে গড়ে উঠেছে। পুরাতন ও অচল হয়ে যাওয়া জাহাজ এখানে ভাঙা হয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশে প্রাচীন পদ্ধতিতে জাহাজভাঙার কাজ চলছে। স্বল্প মূলধন বিনিযয়োগ করে সস্তা পারিশ্রমিকে অধিক লোক বল পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় এখানে এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতেই জাহাজভাঙা হয়। ১৫০টির বেশি ইয়ার্ডের রেজিস্ট্রেশন থাকলেও সক্রিয় ইয়ার্ডের সংখ্যা মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি। এ শিল্পের সাথে সরাসরি প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক জড়িত এবং পরোক্ষভাবে আরো প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এ শিল্পের সুবিধাভোগী।

স্থানীয় রড ও ইস্পাতশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৬০ শতাংশের বেশি জোগান দেয়া হয় এ শিল্প থেকে। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় স্টিল ও রিরোলিং মিল। এছাড়াও ভাঙার জন্য আনা জাহাজগুলোতে অনেক পুরাতন ভাল ও উন্নতমানের আসবাবপত্রসহ বহু মূল্যবান গৃহস্থালিসামগ্রী পাওয়া যায়। এ সকল পুরাতন আসবাবপত্র ও গৃহস্থালিসামগ্রী বিক্রির জন্য এখানে অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে জাহাজভাঙা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু এই শিল্পে কমর্রত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পেশাগত নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। সরকার ২০১৮ সালে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করলেও অদ্যাবধি কোন ইয়ার্ডেই তা কার্যকর হয়নি। এখানে শ্রম আইনের কোনো বালাই নেই। শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হয় মৌখিকভাবে। কোন নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রেও কোন নিয়ম মানা হয় না। মৌখিক নির্দেশেই যে কোন সময় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি নিত্যনৈমিত্তিকব্যাপার। রাত্রিবেলায় কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও রাত্রিবেলায় কাজ বন্ধ করা যায়নি।

শ্রমিকরা কেবল কাজ করলেই মজুরি পেয়ে থাকে। ফলে শ্রম আইন অনুযায়ী তারা কোন বেতন ছুটি পায় না। দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে এবং ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে বিধায় শ্রমিকেরা আহত বা নিহত হলে নিয়োগকর্তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পয়ে। ইয়ার্ডের মূল মালিকরা দায় নিতে চাই না।

প্রচারমাধ্যম, এনজিও, শ্রমিক সংগঠন ও সরকারি তদারকি সংস্থার তৎপরতার কারণে বর্তমানে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতের মিছিল যেন থামছেই না। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে ১৫/১৬ জন শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করে। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ২৩ জন শ্রমিক মারা গিয়েছিল। করোনাকালীন কাজ কম হওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সালে ১০ জন এবং চলতি বছর ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আবার আহত হয়ে স্থায়ী কিংবা আংশিক পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে অসংখ্য শ্রমিক। আহত শ্রমিকেরা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সুচিকিৎসা এবং পঙ্গু শ্রমিকেরা শ্রম আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পায় কিনা তারও কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই।

এমনিতেই জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপর ইয়ার্ডের মালিকরা নিজেরা সরাসরি জাহাজভাঙার কাজ না করে ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাজ করায়। অধিকাংশ ঠিকাদারদের মূলধন বিনিয়োগের সক্ষমতা কম থাকার কারণে শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে না। অভিযোগ রয়েছে, শ্রমিকদের পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জামাদি (চচঊ) সরবরাহ করা হয় না। এছাড়া জাহাজে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান এসবেস্টস পরিবেষ্টিত পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বিধায় তাদের ফুসফুসের জটিল রোগ, ক্যান্সারসহ নানাবিধ পেশাগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

ফলে একটি অরক্ষিত ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশে জাহাজভাঙা শ্রমিকেরা কাজ করছে বছরের পর বছর। প্রশ্ন জাগে, এত নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়েও কেন শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে আসে। এই ব্যাপারে জাহাজভাঙা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এখানে অধিকাংশ শ্রমিক আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। তারা আর্থিকভাবে অত্যন্ত অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত দুর্বল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। জীবনের তাগিদে কাজ করতে আসা এই সকল হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে দৃশ্যমান কোন বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে।

যে দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা কোটির উপরে, রুটিরুজির জন্য কাজ জোগাড় করাই যেখানে সোনার হরিণ পাওয়ার মত কষ্টসাধ্য, সেই দেশের হতদরিদ্র এ সকল জনগোষ্ঠীর পক্ষে পছন্দ অনুযায়ী কাজ জোগাড় করা কী নিদারুন কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। বছরের পর বছর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মালিকপক্ষ। দুর্বল, নিপীড়িত ও অসহায় জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রেরও যেন কোন দায় নেই। জীবন বাঁচাতে রুটিরুজির জন্য কাজ করতে এসে শ্রমিকের জীবনই যদি হুমকির মধ্যে পড়ে যায় তা হলে তা কখনোই শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য সুখকর হতে পারে না বরং পুরো শিল্পই হুমকির মধ্যে রয়েছে বলা যায়।

দুর্ঘটনা ঘটার আগেই নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন কারণসমূহ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি যেমন হেলম্যাট, মেটাল হ্যান্ডগ্লাভস, মাস্ক, গামবুট ইত্যাদি সরবরাহ করা আবশ্যক। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তদারকি জোরদার করাসহ কোনো ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য যদি মালিকপক্ষের অবহেলা বা উদাসীনতা প্রমাণিত হয় তা হলে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তারা কাজ করতে করতেই দক্ষতা অর্জন করে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অদক্ষ এবং প্রশিক্ষণবিহীন শ্রমিক দ্বারা জাহাজভাঙার কাজ পরিচালিত হয়। তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাহাজভাঙার জন্য দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে ডাটাবেজভুক্ত শ্রমিক ছাড়া অন্য শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক নিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনার হার অর্ধেকের বেশি কমানো যাবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।

আশির দশকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হওয়া বাংলাদেশের এ শিল্প বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ জাহাজভাঙা শিল্প হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এ শিল্পের অগ্রগতির পেছনে রয়েছে এক করুণ অধ্যায়। শিল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে শ্রমিকের শ্রম ও ঘাম। এবং শত শত শ্রমিকের আত্মদানে এ শিল্পকে টেকসই করতে হলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় শিল্পের স্থায়িত্ব ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

লেখক : প্রোগ্রাম অফিসার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-(বিলস)

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট