চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইস্পাতের কাঁচামালের বড় জোগান দেয় জাহাজভাঙা শিল্প

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:০৯ অপরাহ্ণ

করিম উদ্দিন

ইস্পাতের কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বেড়েই চলেছে। ইস্পাত শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান দিত এখানকার শিপইয়ার্ডগুলো। বর্তমানে অটো রি-রোলিং মিলের সংখ্যা বেড়েছে। এজন্য বিলেট ও স্ক্র্যাপ আমদানিও বাড়ছে। তারপরও রড উৎপাদনের কাঁচামালের বড় উৎস হচ্ছে স্থানীয় ইয়ার্ডগুলো। জাহাজভাঙা শিল্পের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন কেএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক করিম উদ্দিন। খাজা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ও কবির স্টিল লিমিটেড নামে দুটি শিপ ইয়ার্ড রয়েছে এ শিল্প গ্রুপের। আলাপচারিতায় ছিলেন রিপোর্টার মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন-

পূর্বকোণ : জাহাজভাঙা শিল্পের বর্তমান অবস্থা কেমন?

করিম উদ্দিন : আগে জাহাজভাঙা শিল্পের বাজার সংকুচিত ছিল। বিশ্বের গুটিকয়েক দেশে ভাঙা হতো পুরনো জাহাজ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় এর ব্যাপ্তি ও প্রসারতা বেড়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনুন্নত দেশের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো এই ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছে। কারণ যেকোনো দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য ইস্পাতের বিকল্প নেই। আর ইস্পাত খাতের বিকাশের জন্য জাহাজভাঙা শিল্পের গুরুত্বও অনেক। যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

 

পূর্বকোণ : দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাড়ছে ইস্পাতের ব্যবহার। এতে ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এর ফলে জাহাজভাঙা শিল্পকে কোন অবস্থানে দেখছেন?

করিম উদ্দিন :  জাহাজভাঙা শিল্প হচ্ছে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল জোগানের বড় উৎস। ইস্পাত শিল্প সম্প্রসারণের জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হয়, কারখানাগুলোর উৎপাদন চাহিদা মেটানোর জন্য। আগে আমাদের দেশে বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরনো জাহাজভাঙার জন্য শতাধিক ইয়ার্ড ছিল। শ্রমিক সংকট, প্রতিকূল পরিবেশ, সরকারের নানা বিধি-নিষেধের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ইয়ার্ড। এখন ইয়ার্ডের সংখ্যা ২৫-৩০টিতে ঠেকেছে। অথচ এই খাতে ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপে এ শিল্পের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আমাদের বিশ্বাস, এ ধারা অব্যাহত থাকলে জাহাজভাঙা শিল্পের হারানো গৌরব ফিরে আসবে।

 

পূর্বকোণ : জাহাজভাঙার ১৯৭টি শিপইয়ার্ড ছিল। বর্তমানে চালু রয়েছে ৩০-৩৫টি। ইয়ার্ডের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

করিম উদ্দিন : প্রতিকূল পরিস্থিতি ও নানা বিধি-নিষেধের গ্যাঁরাকলে রয়েছে শিপইয়ার্ডগুলো। যা স্বাভাবিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তাই অনেকেই এই ব্যবসার ধরন পাল্টিয়ে অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন। কেউ আবার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও আর্থিক নিরাপত্তার একটা বড় বিষয় এখানে জড়িয়ে রয়েছে। এ শিল্পে ক্রমশই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন হচ্ছে। তবুও অপ্রত্যাশিত-অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। শ্রমিকদের অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা ঘটলেও খেসারত দিতে হয় মালিকদের। কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলেই দেওয়া হয় আমদানি নিষেধাজ্ঞা। যা এ খাতের ব্যবসায়ীদের বড় আর্থিক ক্ষতির কারণ। এছাড়া নানান কারণে শিপ ইয়ার্ডের সংখ্যা ক্রমেই কমছে।

 

পূর্বকোণ : ইয়ার্ডের সংখ্যা কমে গেলেও বাংলাদেশ জাহাজভাঙা শিল্পে কয়েক বছর ধরে বিশ্ব তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে, কীভাবে সম্ভব হয়েছে ?

করিম উদ্দিন :  ২০১৭ সাল থেকে জাহাজভাঙায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে বিশ্বে যত জাহাজ ভাঙা হয়েছে, তার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশই বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছে। ২০১৯ সালেও শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল। ওই বছর বিশ্বে সমুদ্রগামী পুরনো জাহাজ বিক্রি হয়েছে ৬৭৮টি। এরমধ্যে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কিনেছেন ২৩৬ টি জাহাজ। ২০২০ সালে বিশ্বে ৬৩০ টির মধ্যে ১৪৪টি জাহাজ ভেঙেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে ভেঙেছে ৩৪ শতাংশ। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের অসীম সাহস ও কৌশলের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এ কারণে জাহাজভাঙা শিল্পে দীর্ঘদিন নেতৃত্বে থাকা তাইওয়ান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াকে পেছনে ফেলে শীর্ষে ওঠে এসেছে বাংলাদেশ।

 

পূর্বকোণ : বাংলাদেশে ইস্পাত শিল্পে বছরে কাঁচামালের চাহিদা কত? স্ক্র্যাপের চাহিদার বিপরীতে এখানকার জাহাজভাঙা শিল্পগুলো কী পরিমাণ কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে ?

করিম উদ্দিন : দেশে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রড উৎপাদনের কারখানা আছে ৪২টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানার সংখ্যা গত এক দশকে ২৫০ থেকে কমে ১০০ এর নিচে নেমেছে। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানসম্পন্ন রডের বাজার প্রধান পাঁচ কোম্পানির হাতে। জাহাজভাঙা শিল্প থেকে ইস্পাত কারখানাগুলোতে এখন প্রায় ৫০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগেও তা ৭০ শতাংশ ছিল। কিন্তু দেশে অটো রি-রোলিং মিলের সংখ্যা বাড়ছে। এতে আমদানি করা স্ক্র্যাপ ও বিলেটের ব্যবহারও বেড়েছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ আমদানিও বেড়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। পুরনো জাহাজের লোহা ছাড়াও জাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বড় বাজার রয়েছে বাংলাদেশে।

 

পূর্বকোণ : ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই নিজস্ব ইয়ার্ড রয়েছে। আপনাদেরও শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। নিজস্ব শিপইয়ার্ড থাকায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন কি?

করিম উদ্দিন :  পুরো ইস্পাত শিল্প এখন স্ক্র্যাপ আমদানি নির্ভর। কয়েক দশক আগেও ম্যানুয়েল পদ্ধতির রড উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচামালের জোগানদাতা ছিল জাহাজভাঙা শিল্প। এখন অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির কারখানা বেড়েছে। রড উৎপাদন পদ্ধতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তবু জাহাজভাঙা শিল্পের কাঁচামাল ব্যবহার হয় ইস্পাত নির্মাণ শিল্প কারখানায়। আমাদের দুটি শিপ ইয়ার্ড থেকেও নিজস্ব কারখানায় কাঁচামালের জোগান দেওয়া হয়। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বাড়তি সুবিধা।

পূর্বকোণ : সরকার জাহাজভাঙা শিল্প খাত থেকে বছরে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে?

করিম উদ্দিন : পরিতাপের বিষয় হলো, প্রতিবছর জাহাজভাঙা শিল্প থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করলেও সম্ভাবনাময় এই শিল্পের উন্নয়নে আশানুরূপ পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নেয়নি। কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও একেবারেই অপ্রতুল। এতে করে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বিশেষ করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। নানা ছলছুতোয় প্রভাব বিস্তার করে। সুযোগ পেলেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। এছাড়া এই শিল্পকে ঘিরে যেভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। এতে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। বিঘ্নিত হয় ব্যবসার স্বাভাবিক গতি। যার প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত, অবকাঠামো উন্নয়নসহ জাহাজভাঙা শিল্পকে ঘিরে পরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে অমিত সম্ভাবনার জাহাজভাঙা শিল্প।

পূর্বকোণ : দেশে জাহাজভাঙা শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাই-

করিম উদ্দিন : এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। তবে এ শিল্পের কাক্সিক্ষত বিকাশে প্রয়োজন সরকারের বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হবে। যা একটি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। তাই নানা সীমাবদ্ধতা সংকট দূর করে এ শিল্পের বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট