চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাহাজভাঙা শিল্পে উন্মোচিত হবে নব দিগন্ত

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:৪৩ অপরাহ্ণ

কামাল উদ্দিন আহমেদ

 

সীতাকুণ্ডের শিপ ব্রেকিং (জাহাজ ভাঙা) শিল্পের গোড়াপত্তন ১৯৬০-এর দশকে। সাগরে আটকে পড়া একটি জাহাজ কাটাকুটি থেকেই গড়ে ওঠে বিশাল এ শিল্প। বর্তমানে বিশ্বের বড় ও শীর্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পের ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন, সমস্যা-সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ। আলাপচারিতায় ছিলেন রিপোর্টার মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন-

 

প্রশ্ন : জাহাজভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন কীভাবে তা একটু জানতে চাই।

কামাল উদ্দিন : শুরু পাকিস্তান আমলে। তুফানে আটকে পড়া জাহাজ ভাঙতে গিয়ে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ছিলেন হাতেগোনা কয়েক জন ব্যবসায়ী। আমি শুরু করেছি ১৯৮৪ সালে। ২০০৮ সালের আগেও আমরা ২২-২৫ জন ছিলাম। এরপর প্রসারতা বাড়তে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে বিশাল আকার রূপ নেয়। এসোসিয়েশনভুক্ত হন ১৫৪ জন। এরমধ্যে অনেক ঝড়-তুফান বয়ে গেছে। অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। বর্তমানে আছেন ৫০-৫২ জন। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার নতুন বিনিয়োগও হয়েছে। এগিয়ে এসেছেন বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা। ব্যবসার আকার বড় হয়েছে। তবে গত তিন বছর ধরে আমরা ভালো করছি। বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছি।

 

প্রশ্ন : ৬২ বছর পার করেছে এ শিল্প। বর্তমান অবস্থা কেমন ?

কামাল উদ্দিন : আল্লাহর রহমতে ভালো। বছরে ২৫-২৬ লাখ টন ওজনের জাহাজ আমদানি করছি। যা দেশীয় ইস্পাতশিল্পের কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে। এটি ছিল আগে শিপব্রেকার্স। এখন হয়েছে শিপ ব্রেকার্স এ- রিসাইক্লিং শিল্প। জাহাজের প্রতিটি পণ্য পুনর্ব্যবহার হচ্ছে। যেমন : রান্নাঘরের তৈজস-আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ক্যাবল (তার), তামা, লোহা, নাটবল্টু, জেনারেটর প্রতিটি পণ্যই বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে পুনর্ব্যবহার হচ্ছে। আবার অনেক পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। কোটি টাকা দামের জেনারেটর ও অন্যান্য মেশিনারি যন্ত্রাংশও পাওয়া যায়। যা জাহাজনির্মাণ ও শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হয়। এক কথায় পুরোনো জাহাজের কোনো পণ্যই ফেলার নয়।

 

প্রশ্ন : বলা হয়, ইস্পাতশিল্পের কাঁচামালের বড় উৎস জাহাজভাঙা শিল্প। উৎস কমে গেলে কী ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে ?

কামাল উদ্দিন : শিপব্রেকার্স শিল্প না হলে তো রডের দাম টনপ্রতি এক লাখ টাকা হতো। কারণ এখানে তো লোহার কোনো খনি নেই।  জাহাজভাঙা শিল্প থেকে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে। এটা হচ্ছে লোহার ভাসমান খনি। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। পদ্মাসেতু, টানেল-মেট্রোরেল হচ্ছে। শিল্পজোন হচ্ছে। ছোট-বড় সব প্রকল্পে শতভাগ রডের জোগান দিচ্ছে স্থানীয় উৎপাদিত রড। অথচ এক সময়ে ছোট প্রকল্পের জন্য রড আমদানি করতে হতো। কয়েক বছর আগেও রড আমদানি ওপেন ছিল। এখন উৎপাদন স্বয়ংস্পূর্ণ হওয়ায় আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে হয়তো আমদানি আবার ওপেন করে দেবে।

 

প্রশ্ন : দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল ? তা কীভাবে মোকাবেলা করেছেন ?

কামাল উদ্দিন : বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পরিবেশবাদীরা। আমাদের নানাভাবে হেনস্থা করেছে। মামলা করে শিপব্রেকিং বন্ধ পর্যন্ত করে দিয়েছিল। অথচ, আপনি দেখবেন, সোনার গাঁ হোটেলের সামনে যে পরিমাণ পরিবেশ দূষণ হয়, আমাদের এখানে তারচেয়ে অনেক কম। ‘৮০ সালের আগে তৈরি করা জাহাজে এলবেস্টার থাকতো। পরবর্তীতে পরিবেশ দূষণ করে এমন পণ্য আর জাহাজে লাগানো হয় না। এছাড়াও আনা জাহাজের নানা ধরনের ক্ষতিকারক বর্জ্য ও পদার্থ সাগরে ফেলা হতো। এখন তা হয় না। এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের কাছে আমাদের নানা দাবি ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটাকে শিল্প ঘোষণা করেছেন। নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ শিল্পের উন্নয়নে নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের সহায়তায় আমরা সব চ্যালেঞ্জ-বাধা উতরে এগিয়ে যাচ্ছি।

 

প্রশ্ন : এ শিল্পের আগামীর চ্যালেঞ্জ কী বলে মনে করেন ?

কামাল উদ্দিন : এখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্রিন শিপইয়ার্ড (পরিবেশবান্ধব) করা। ২০২৩ সালের মধ্যে সবকটি ইয়ার্ডকে গ্রিনইয়ার্ডে রূপান্তর করতে হবে। ইতিমধ্যেই আমরা ৮০টি এসআরএফপি শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। করোনার কারণে পরিদর্শনে আসতে পারেনি সার্ভেয়ার দল। পরিদর্শন হয়ে গেলেই ৮-১০টি ইয়ার্ড সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। আশা করছি, সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সবকটি ইয়ার্ড পরিবেশবান্ধব ইয়ার্ডে রূপ পাবে।

প্রশ্ন : চট্টগ্রামের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সদর দপ্তর ঢাকামুখিতাকে বড় বাধা মনে করছেন উদ্যোক্তারা। জাহাজভাঙা শিল্প এ নিয়ে কী ধরনের সমস্যা বা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে ?

কামাল উদ্দিন : এটা অস্বীকার করার মতো নয়। একটি জাহাজ ভাঙার অনুমতির জন্য ঢাকায় অন্তত চারবার ছুটোছুটি করতে হয়। শিল্প, পরিবেশ, নৌ-মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি দপ্তরে ঘোরাঘুরি করতে হয়। কতো দেন-দরবার, ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। তবে দীর্ঘদিন পর সুখবর হচ্ছে, চট্টগ্রামে শিপব্রেকিং শিল্পের বোর্ড অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্গানোগ্রাম অনুমোদন হয়ে গেছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব। কমিটিতে থাকবেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের দু’জন উপসচিব, পরিবেশ, শিল্প-বাণিজ্য, নৌ পরিবহন, শ্রম মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, নেভাল একাডেমি, বন্দর প্রতিনিধি ও শিপব্রেকার্স এসোসিয়েশনের দুজন প্রতিনিধি। এখন শুধু কার্যালয় স্থাপনের অপেক্ষা। তখন চট্টগ্রামেই এক ছাদের নিচে জাহাজভাঙা শিল্পের সব ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। ঢাকায় এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ছুটোছুটি আর করতে হবে না।

 

প্রশ্ন : শ্রমিকদের সুরক্ষা ও পরিবেশ দূষণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন ?

কামাল উদ্দিন : পরিবেশ দূষণরোধে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (টিএসডিএফ) নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাইকার সহায়তায় কয়েক শ কোটি টাকা ব্যয়ে তা নির্মাণ করা হবে। বাড়বকু- এলাকায় জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্রতিটি ইয়ার্ডে এখন শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নানা ব্যবস্থা রয়েছে। আইনে বাধ্যবাধকতা করে দিয়েছে। প্রতিটি ইয়ার্ডে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের নেতৃত্বে প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও আমাদের নিজস্ব হাসপাতাল আছে। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে উন্নতমানের ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। সব ব্যয় নির্বাহ করছেন মালিকেরা। আগের তুলনায় এখন কর্মপরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। শ্রম নিরাপত্তায় জোর দেওয়ায় দুর্ঘটনাও কমে এসেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। আগে ৪০-৫০ জন শ্রমিক কাঁধে প্লেট ট্রাকে তুলতো। এখন একটি ক্রেন দিয়ে তা লোড করা হচ্ছে।

 

প্রশ্ন : একসময়ে ১৫৪টি ইয়ার্ড ছিল। এখন ৫০-৫২টিতে ঠেকেছে। এর কারণ কী ?

কামাল উদ্দিন : সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দাম স্থিতিশীল থাকে না। উত্থান-পতন হয়েছে। বড় ব্যবসায় ঝুঁকিও বেশি। একেবারে খাতুনগঞ্জের মতো। খাতুনগঞ্জে যেমন সব ব্যবসায়ী টিকতে পারেননি। এখানেও একই অবস্থা। উত্থান-পতনের ঢেউয়ে টিকতে না পেরে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গেছে।

 

প্রশ্ন : এ শিল্প থেকে সরকার প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে আপনার কী কী সুবিধা পাচ্ছেন ?

কামাল উদ্দিন : এখানে সরকারি কোনো সহায়তা পাচ্ছি না। সরকার শুধু ট্যাক্স নিচ্ছে। আমাদের দাবি ছিল, ঋণের বিপরীতে সুদের হার ও ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর। তা করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে এটিই একমাত্র শিল্প, অগ্রিম ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে জাহাজ আমদানি করা হয়। জাহাজ ভাঙার পর কাঁচামাল বিক্রির ভ্যাটও অগ্রিম দিচ্ছি। কিছুদিন আগেও কয়েকটি ইয়ার্ডের কাগজপত্র নিয়ে গেছে। সরকারের নির্দেশনা মতে, আমদানিকৃত জাহাজের ওজন অনুযায়ী আমরা আগেই ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করে আসছি। এখন নতুন করে দাবি করা হচ্ছে, জাহাজের ভেতরে যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য মালামালের জন্য আলাদা করে ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু আমরা জাহাজ কেনার সময় সব একসঙ্গে ওজন ধরে কিনি।

 

প্রশ্ন : জাহাজভাঙার মতো বড় বিনিযোগে ব্যাংক ঋণ ও সুদ-হারের কী অবস্থা ?

কামাল উদ্দিন : বিশ্বের  কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের সুদের হারের মিল নেই। বিদেশে ২-৩ শতাংশের ওপরে ব্যাংক সুদ নেই। আমাদের দেশে সবনিম্ন সুদ ৯ শতাংশ। সরকার তা নির্ধারণ করা দিয়েছে। অবশ্য, আগে তা ১২ শতাংশ ছিল। সুদের হার কমানোর জন্য সরকারের কাছে আমরা অনেক দেন-দরবার করেছি। সুফল পাইনি।

 

প্রশ্ন : জাহাজভাঙা শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন ?

কামাল উদ্দিন : দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। ইস্পাতশিল্পের চাহিদাও বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে অটো রি-রোলিং মিল স্থাপন করা হচ্ছে। আর রড উৎপাদনের কাঁচামালের প্রধান উৎস হচ্ছে জাহাঙভাঙা শিল্প। নিঃসন্দেহে বলা চলে, রড তৈরির জন্য জাহাজভাঙা শিল্পের বিকল্প নেই। এছাড়াও জাহাজনির্মাণ শিল্পেরও কাঁচামালের জোগান দেয় এ শিল্প। আর জাহাজের পুরোনো পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক বড়। সবমিলে সাতটি শিল্পের কাঁচামালের জোগান দেয়। এতে অন্তত ২০ লাখ মানুষ এ শিল্পে জড়িত। ব্যাংক-বীমাসহ দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে জাহাজভাঙা ও জাহাজনির্মাণ শিল্প। দেশের উন্নয়নের জন্য ও দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট