চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাহাজের আলোঘর সুইচবোর্ড

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৪:২৩ অপরাহ্ণ

মোর্শেদ নয়ন

 

জাহাজের ‘সুইচবোর্ড’ তৈরি হচ্ছে এদেশে। তা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এক সময়ে এ সুইচবোর্ড আমদানি করতে হতো। এখন সেই সুইচবোর্ড তৈরি হচ্ছে নদীর ওপারে, কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটায়। নদী কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানায় ঢুকতেই কানে বেজে যন্ত্রপাতির টুংটাং টুংটাং শব্দ। কাজের ব্যস্ত শ্রমিক-কর্মচারীরা।

প্রায় ৩৮ হাজার বর্গফুটের জায়গায় থরে থরে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। প্রকৌশলী, ইলেকট্রিশিয়ান ও কর্মীদের কর্মব্যস্ততা। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ‘ওশান ইলেকট্রিকেল লিমিটেড’ নামের এই মেরিন সুইচবোর্ড তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত বাংলাদেশ মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিজের সুইচবোর্ড আমদানি নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে একদল দক্ষ প্রকৌশলী এ কারখানা গড়ে তুলেন। কারণ দেশে নির্মিত জাহাজের ক্লাস ও মালিক পক্ষের চাহিদা মতো এই ‘সুইচবোর্ড’ জার্মানি, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হত। আমদানি প্রক্রিয়া যেমন ব্যয়বহুল ছিল, তেমন ছিল সময় সাপেক্ষ। সেই তাগিদে দেশে সুইচবোর্ড নির্মাণের পরিকল্পনা নেন এক অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। এটি এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মেরিন ক্লাস সার্টিফাইড সুইচবোর্ড তৈরির প্রথম ও একমাত্র প্রতিষ্ঠান।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে চট্টগ্রাম বন্দরের পানি পরিবহনকারী জাহাজ ‘জলপরী’ নির্মাণের দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই জাহাজে প্রথম সুইচবোর্ড সরবরাহের ক্রয়াদেশ পায় কোম্পানিটি। সফলভাবে সুইচবোর্ড নির্মাণ ও বসানোর পর আর পেছনে থাকাতে হয়নি।

দেশে সুইচবোর্ড নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কমান্ডার (অব.) এনামুল হক। তিনি বললেন, সুইচবোর্ড বলতে শুধু ইস্পাতের বড় বাক্সে সাজানো বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামের স্তূপের কথা ভাবলে ভুল হবে। জাহাজের সব সরঞ্জামের মতো সুইচবোর্ড তৈরিতে বৈশ্বিক মান বজায় রাখতে হয়। জাহাজনির্মাণের আগে জাহাজের ক্লাস অনুযায়ী নকশা তৈরি, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির গাইড লাইন অনুযায়ী সুইচবোর্ডের নকশা অনুমোদনের জন্য আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। গাইড লাইন অনুসরণ করা হয়ছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই নকশা অনুমোদন দেয়া হয়। সুইচ তৈরিতে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, স্নোভেনিয়া, ভেনিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়। যেমন-সুইচ গিয়ার, জেনারেটর কন্ট্রোলার, সিঙ্কোনাইজিং প্যানেল, প্রটেক্টিভ ডিভাইস, সার্কিট ব্রেকার, ক্যাবল, ক্যাবল ডাক্ট, ট্রান্সফরমার, বাস বার, মেজারিং মিটার, পুশ বাটন/ইন্ডিকেটর ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জাহাজে বসানোর পর চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। প্রতিটি ধাপে মান নিশ্চিতের পরই মিলে চূড়ান্ত সনদ। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি স্বীকৃত ছয়টি আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যেমন, DNV-GL, BV, RINA, Class-NK, IR Class, LR আমাদের নির্মিত সুইচবোর্ডের মান সনদ দিয়েছে। আমাদের তৈরি সুইচবোর্ড আন্তর্জাতিক মান ও ক্লাস সম্পন্ন হলেও তুলনামূলকভাবে দাম আমদানির মূল্যের প্রায় অর্ধেক।

কারখানা প্রতিষ্ঠার নেপথ্য

ওশান ইলেকট্রিকেল লিমিটেড’ নামের মেরিন সুইচবোর্ড তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের গল্প শোনালেন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কমান্ডার (অব.) এনামুল হক। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের দিকে পটিয়ার কোলগাঁওয়ে জাহাজনির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে বৈদ্যুতিক বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করি। তখন দেখলাম, বিদেশ থেকে সুইচবোর্ড আনতে গড়ে চার মাসের বেশি সময় লেগে যেত। নকশা প্রণয়ন থেকে নির্মাণ পর্যন্ত বিদেশি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শতাধিকবার মেইল চালাচালি করতে হতো। সব প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানিমুখী জাহাজে সুইচবোর্ড বসাতে খরচ ও সময় দুটোই বেশি লাগত। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দেশে সুইচবোর্ড তৈরির চিন্তা মাথায় আসে। প্রথমে ওয়েস্টার্ন মেরিনে নির্মিত দুটি যাত্রীবাহী জাহাজের জন্য প্রথমবারের মত সুইচবোর্ড তৈরির কাজ শুরু হয়। এর মাধ্যমে সুইচবোর্ড তৈরির শক্তি-সামর্থ্য ও সাহস তৈরি হয়। এরপর ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আরো দুইজনকে নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে চরপাথরঘাটায় কারখানা নির্মাণের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের মার্চে প্রাথমিক মূলধন ছিল ৬০ লাখ টাকা। প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানের ৬৫ জন দক্ষ কর্মী বাহিনী নিয়ে কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। এখন ২০ জন ইঞ্জিনিয়ারসহ ১১০ জন কর্মী নিয়োজিত আছেন।

দেশে তৈরি এই সুইচবোর্ডের উল্লেখযোগ্য ক্রেতা হল, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড, খুলনা শিপইয়ার্ড, রেডিয়্যান্ট শিপইয়ার্ড, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন, কনফিডেন্স ওয়েল এন্ড শিপিং লি., আমান শিপইয়ার্ড এন্ড স্লিপওয়ে লি, জে কে মেরিটাইম, বাংলাদেশ নেভি,  চট্টগ্রাম ড্রাইডক লি. ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা লে. কমান্ডার (অব.) এনামুল হক বলেন, কারখানার কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক গুণতে হয়। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেকটা বেড়ে যায়। সরকার কাঁচামাল আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা পেলে সম্ভাবনাময়ী এ খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

লে. কমান্ডার (অব.) এনামুল হক বলেন, এ পর্যন্ত ২০০টি জাহাজের সুইচবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এখন ৩০টি জাহাজের সুইচবোর্ড তৈরির কাজ চলছে। শতভাগ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সুইচবোর্ড সরবরাহ করা হয়। সুইচবোর্ড ছাড়াও মেরিন কারখানার সকল ধরনের অটোমেশন/কন্ট্রোল সিস্টেম (যেমন-ব্যাটারির চার্জার, নেভিগেশন লাইট কন্ট্রোল প্যানেল, ইঞ্জিন টেলিগ্রাফ, এলার্ম  প্যানেল তৈরি করা হয়। এখন শুধু জাহাজ নির্মাণ নয়, জাহাজের সুইচবোর্ড থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক বাল্ব ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণে বিশ্ব অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট