চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশ্বকর্মাদের বিশ্বজয় সরের জাহাজ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:২৩ অপরাহ্ণ

এ এক বিস্ময়কর! করাত, চেনি, বাটালি, হাতুড়ির মতো ছোট দেশীয় যন্ত্র দিয়ে ঠুংটান ঠুংটান করেই তৈরি হয়ে গেল বিশাল এক জাহাজ। বলা হতো সরের জাহাজ। কাঠের তৈরি এ জাহাজ ঘুরে বেড়াত সাত সমুদ্র, তেরো নদী। হাজার বছর আগে অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব দেখেছে চট্টগ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন-নিরক্ষর ঈশান মিস্ত্রিদের প্রাণশক্তি। এ সরের জাহাজ চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। বংশ পরম্পরায় স্থাপত্যবিদ্যায় পারঙ্গম স্থপতির মতো নির্মাণ করতেন সব আশ্চর্য আশ্চর্য জাহাজ। তারা কখনো প্রকৌশলীবিদ্যার ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। তাই, আজকালের স্থপতি-প্রকৌশলীদের মতো পুরাণকালে এ জাহাজনির্মাণ শিল্পীদের ‘বিশ^কর্মা’ খেতাব ছিল।

ইতিহাস বলছে, বঙ্গের হিন্দু আমলের তা¤্রলিপ্ত বন্দরের মতো সুপ্রাচীনকালে চট্টগ্রামে পালের জাহাজনির্মাণের প্রধানকেন্দ্র ছিল। সেকালে পালবাহী, দাড়টানা কাঠের তৈরি জাহাজকে সরের জাহাজ বলা হতো। আরব বণিকেরাই এদেশে জাহাজের প্রচলন করেন। তাদের কাছ থেকে কলাকৌশল শিখেছেন এ অঞ্চলের মানুষ। চট্টগ্রামের জাহাজনির্মাণ শিল্পের ইতিহাসও হাজার বছরের বেশি বলে মত দিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। শতবর্ষ প্রাচীন জাহাজনির্মাণ ও নদীতে ভাসানোর প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ রয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকায়। সেই বর্ণনা মতে, ১৯১৪ সালে ‘আমীনা খাতুন’ নামে জাহাজ ভাসানো হয় কর্ণফুলীতে। তবে তারও এক শ’ বছর আগে ১৮১৮ সালে ফ্রিগেট ডয়েচল্যা- নামে একটি জাহাজের সন্ধান পাওয়া যায়। যেটি সংরক্ষিত­­­­ রয়েছে জার্মানির নৌ-জাদুঘর ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ফ্রেজার এ- কোম্পানি চট্টগ্রামের জাহাজনির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেমস ম্যাকরের সঙ্গে মহাসাগরে চলাচল উপযোগী জাহাজটি নির্মাণ করেছিল। চট্টগ্রামের সদরঘাটে তা নির্মাণ করা হয়েছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ ছিল চট্টগ্রাম। মূলত নৌ-বাণিজ্য। ইতিহাসবিদ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘ইসলামাবাদ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমাদের এই দেশ চিরদিন বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। ইহার বাণিজ্য খ্যাতিতে প্রলুদ্ধ হইয়া আরবগণ স্মরণাতীতকাল পূর্ব হইতে ইহার সহিত বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন। ইহার বাণিজ্য খ্যাতি প্রাচ্যদেশ ছাড়াইয়া সুদূর ইয়োরোপ পর্যন্ত পৌঁছায়াছিল।’ চট্টগ্রামের নৌ-বাণিজ্যের ইতিহাস প্রাক ইসলামিক যুগ থেকে। ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন, ‘চাটগাঁও কত প্রাচীন তা বলা কঠিন। খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতক থেকেই আরবগণ চীন ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। চাটগাঁও দুই হাজার বছর পর এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দররূপে পরিগণিত ছিল।

১৫৬৩ হতে ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যবর্তী সময়ে ভিনিসীয় বণিক সিজারো ফ্রেডারিটি এশিয়া পরিভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণ-বৃত্তে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণোপযোগী দ্রব্যাদি এত প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় যে, কনস্টান্টিনোপলের (রোমের) সুলতান এ স্থানে জাহাজ নির্মাণের ব্যয় অল্পতর বলে এখানেই জাহাজ নির্মাণ করতেন।’ এ থেকেই বোঝা যায়, চট্টগ্রাম সুপ্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সরের জাহাজ-ই ছিল বাণিজ্যের প্রধান বাহন। সেসময়ে এদেশেই সব ধরনের জাহাজ নির্মিত হতো। চীনা পরিব্রাজক মাহুন্দের বর্ণনা মতে, ‘এদেশের জাহাজনির্মাণ প্রণালীর শ্রেষ্ঠতা হৃদয়ঙ্গম করে রোমের সম্রাট চট্টগ্রাম থেকেই জাহাজ নির্মাণ করে নিতেন। মধ্যযুগে তুরস্কের সুলতানও এখান থেকে সরের জাহাজ বানিয়ে নিয়েছেন।’

বাণিজ্যের সঙ্গে চট্টগ্রামের সরের জাহাজ নির্মাণেও বিশে^ খ্যাতি ছিল। মধ্যযুগে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণে হালিশহর ও পতেঙ্গায় জাহাজনির্মাণ কারখানা ছিল। জাহাজনির্মাণ কারিগর বা শিল্পীরাও ছিল ওই এলাকার। সব ধরনের জাহাজ নির্মাণে ঐশীশক্তি ছিল তাঁদের। অথচ স্থাপত্যবিদ্যায় বর্ণজ্ঞানশূন্য কারিগররা নিজেদের প্রাণশক্তির বলে বড় বড় জাহাজ তৈরি করতেন। দেশীয় যন্ত্র চেনি, বাটালি, হাতুড়ি ও করাত দিয়ে ঠক-ঠক করে হাতেই তৈরি করতেন সব ধরনের জাহাজ। ঈশান চন্দ্র মিস্ত্রি খুবই প্রসিদ্ধ ও দক্ষ  কারিগর ছিলেন। ঈশান মিস্ত্রির হাটের নাম এখনো প্রসিদ্ধ। একই সঙ্গে ইমাম আলী মিস্ত্রি নামে আরেকজনের নাম প্রসিদ্ধ ছিল। আগ্রাবাদে ছিল তাঁর বাড়ি। কথিত ছিল, মানুষ কেটে হুবহু জোড়া লাগাতে পারতেন তাঁরা। শুলকবহর ও ষোলশহর এলাকার গুদীর পাড়ায় আবর বণিকদের জাহাজনির্মাণ করা হতো। আরব বণিকেরা এখান থেকে জাহাজনির্মাণ করতেন।

সুপ্রাচীন কাল থেকেই চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজ ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ, চীনদেশ, ব্রহ্মদেশ, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান-জাভা, সুমাত্রাসহ সুদূর মিশর পর্যন্ত যাতায়াত ছিল। মুসলিম শাসনের অবসান ও ইংরেজ শাসনের শুরুতে চট্টগ্রামের হিন্দু ও মুসলমানদের অনেক জাহাজ ছিল। সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্য বোঝাই করতো। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ চালানো চট্টগ্রামবাসীর প্রাচীন পেশা।

‘আমীনা খাতুন’ নামে একটি জাহাজ কর্ণফুলী নদীতে ভাসানোর বর্ণনা রয়েছে ‘প্রবাসী পত্রিকায়’। প্রত্যক্ষদর্শী মোহিনীমোহন দাস বলেছেন, ‘১ চৈত্র রবিবার চট্টগ্রামের ধনীশ্রেষ্ঠ সওদাগর আবদুর রহমান দোভাষী সাহেবের ‘আমীনা খাতুন’ নামক একখানা বৃহৎ নূতন দৈশীয় তৈরি জাহাজ জলে ভাসান হইয়াছে। দোভাষী সাহেবের কন্যা আমীনা খাতুনের নামানুসারে এই জাহাজের নামকরণ হইয়াছে। বাণিজ্য পোতার নামকরণ ব্যবস্থা আবহমান কাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। কবি কঙ্কন চ-ীর ধনপতি ও মনসা-পুঁথির চাঁদ সওদাগর প্রভৃতির প্রত্যেক সমুদ্রগামীর পোতার বিশেষ বিশেষ নাম ছিল।’ ৪০ জন মিস্ত্রি টানা এক বছর কাজ করে এ জাহাজ নির্মাণ করেছেন। মিস্ত্রি বা কারিগরদের বাড়ি ছিল হালিশহরে। প্রধান মিস্ত্রি ছিলেন কালীকুমার দে। ১৯১৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯১৪ সালের ১৫ মার্চ জাহাজটি নদীতে ভাসানো হয়। নির্মাণ খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। মোহিনীমোহন দাস বলেন, অশিক্ষিত কারিগর দিয়ে বৃহৎ জাহাজনির্মাণ সহজ কথা নয়। যারা কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। কোনো প্রকার কলের যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দেশী হাতুড়ি, বাটালি ও করাতের সাহায্যে বিরাট জলযান নির্মাণ করতে পারতেন। তাঁরা ঐশীশক্তিসম্পন্ন কোনো সন্দেহ নেই। বিলাতি জাহাজের চেয়ে চট্টগ্রামের তৈরি জাহাজের স্থায়িত্ব বেশি ছিল। এসব জাহাজে কামান, বন্দুক, গোলা-বারুদে পূর্ণ থাকিত।

চট্টগ্রামে জাহাজনির্মাণ কারখানা ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত প্রভাব-বলয় বিস্তার করেছিল বলে ইতিহাসবিদ হন্টারের লিখনীতে জানা যায়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি কালে রামসুন্দর সেনের বকল্যা- নামক সরের জাহাজখানি চট্টগ্রামি নাবিকদের পরিচালনায় স্কটল্যান্ডের ‘টুইড’ বন্দরে মালামাল পৌঁছে দিয়েছিল। হালিশহরের উজির আলী সওদাগরের রহমানী নামক সরের জাহাজখানি ভারত মহাসগারীয় বন্দর ও দ্বীপপুঞ্জে বহুবার যাতায়াত করেছিল। বিখ্যাত আরবীয় পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মালাবার উপকূল হতে মালদ্বীপ হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং এ দেশীয় তৈরি জাহাজে চড়ে জাভা দ্বীপ হয়ে চীন পরিভ্রমণ করেন।

প্রাচীনকালের সেই ঔজ্জ্বল্য ইতিহাস এখন নির্বাণোন্মুুখ। তারপরও বিশ^কর্মারা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আমাদের গৌবরোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক পালতোলা নৌকা-সরের জাহাজ শো-পিস বা জাদুঘরে শোভাবর্ধন নয়, এখনো নদী-সাগরে রাজহংসীর ন্যায় ভাসছে। ঈশান ও ইমাম আলী মিস্ত্রিদের উত্তরসূরি সেই বিশ্বকর্মাদের স্বকীয় উদ্ভাবনী শক্তি ও বাহুবলের পরিচায়ক মেলে সদরঘাট, ফিশারিঘাট, চাক্তাই ও হালিশহর ও পতেঙ্গায়।  তৈরি হয় কাঠের বড় বড় জাহাজ। মাছ ধরা ও বাণিজ্যিক জাহাজ। তবে পালতোলা-সরের জাহাজে লেগেছে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া। বসানো হয় হচ্ছে উচ্চশক্তির ইঞ্জিন। জিইয়ে আছেন ঈশান চন্দ্র ও ইমাম আলী মিস্ত্রিদের উত্তরসূরি পুরাণকালের সেই ‘বিশ্বকর্মরা’।

তথ্যসূত্র : চট্টগ্রামের ইতিহাস, ওহীদুল আলম, ছৈয়দ আহমদুল হক, চট্টগ্রামের শিল্প ও বাণিজ্য, আবদুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য আবদুল হক চৌধুরী, বন্দর শহর চট্টগ্রাম চট্টগ্রামের ইতিহাস, কমল চৌধুরী সম্পাদিত উপনিবেশ চট্টগ্রাম, হারুন রশীদ, পূর্বস্বর, চট্টগ্রাম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ইসলামাবাদ।

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক পূর্বকোণ

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট