চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের স্মারক সাম্পান

রেজা মুজাম্মেল

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:৫১ অপরাহ্ণ

প্রতিটি জেলা কিংবা স্থানের নিজস্ব ঐতিহ্য, স্মারক, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রতা থাকে। এ স্বকীয়তা জেলা, এলাকা কিংবা স্থানকে সর্বত্র উপস্থাপন করে। তুলে ধরে জেলার শ্রেষ্ঠত্ব। সেই বৈশিষ্ট্য-বিশেষণ কখনো কখনো জাতীয় ঐতিহ্যকেও অতিক্রম করে। এক সময় সেই বৈশিষ্ট্য দেশের জাতীয় ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে মূল্যায়িত হয়। চট্টগ্রাম  জেলারও আছে কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য-বিশেষণ। তদুপরি ‘চট্টগ্রাম’ নিজেও নানা অভিধা-বিশেষণে বিশেষায়িত। এর মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্য-স্মারক হিসাবে স্বীকৃত ‘সাম্পান’। চট্টগ্রামে সাম্পানকে নৌকাও বলা হয়। সাম্পান বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের স্মারক।

সাম্পান গ্রাম বাংলার প্রতীক। সাম্পান গ্রামীণ প্রতিকৃতির প্রতিচ্ছবি। সাম্পান চিরায়ত বাংলার লোকজ প্রতীক। এই সাম্পানের মধ্যেই লুকায়িত দেশের গ্রাম-বাংলার নানা  স্মারক। চট্টগ্রামের সঙ্গে এই সাম্পানের আছে একটা অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। সাম্পান নামটি আসলেই স্বাভাবিকভাবে চলে আসে চট্টগ্রামের নাম।  চট্টগ্রামের সঙ্গে সাম্পানের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। বলা চলে, সাম্পান চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক-প্রতীক। চট্টগ্রাম নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- ‘সাম্পান, শুঁটকি, দরগা-এ নিয়ে চাটগাঁ’। এটির সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীর জীবন-জীবিকার সম্পর্কও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাম্পান চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আঙিনার প্রোজ্জল এবং দেদীপ্যমান একটি নাম। সাম্পান কর্ণফুলী নদীর হাজার বছরের ঐতিহ্যও বটে।

সাম্পান শব্দটা এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে। সাং পাং শব্দ দুটোর অর্থ হচ্ছে তিন মাথা। সাধারণত নৌকা বা অন্যান্য নৌযানের দুটো মাথা বা গলুই থাকে। কিন্তু সাম্পানের বেলায় মাথা বা গলুই রয়েছে তিনটি। সামনে একটি আর পেছনে দুইটি। পেছনের গলুই দুটো মোষের শিংয়ের মত দু’ভাগে ভাগ করা। এ কারণেই এই নৌযানের এমন নাম। অন্যদিকে, বর্মী ভাষায় সাম্পানকে বলে ‘থাম্মান’। জাপানিতে বলে ‘জুমপেন’ আর মালয়ীতে বলে ‘সামপেন’। ছোট থেকে হাজার মণের পর্যন্ত সব সাম্পানেই একটা মাস্তুল বা মসকুর থাকে।    ওই মাস্তুলেই পাল খাটানো (বাঁধানো) হয়। কখনও কখনও আরও একটা ছোট তিন কোণা পাল বা ‘জীপ সর’ ছোট খুঁটিতে খাটানো হয়।

চট্টগ্রামে সাম্পান তৈরি হয়- কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়, উত্তর পাড়ের চাক্তাই, রাজাখালী, ফিশারিঘাট, ১৫ নং ঘাট, হালিশহর, পটিয়ার কোলাগাঁও, লাখেরা, চানখালির উজান, আনোয়ারা বরকল, শঙ্খ নদীর উজান, হালদা নদীর উজান এবং সন্দ্বীপে। তাছাড়া কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, টেকনাফ, চৌফলদ-ী, ভারুয়াখালি, রামু, গুমাতলী, বালুখালি, গুনধুম, হ্নীলা, চিরিঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় সাম্পান তৈরির বড় বড় কারখানা ছিল। আরাকান ও টেকনাফের সাম্পানগুলোর বেশিরভাগই সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি হত। বিদেশি বাসালো, আজবীসহ বিভিন্ন কাঠ দিয়ে ফিশিং বোট তৈরি করা হয়। চট্টগ্রামে নৌকা চালানোর সময় ‘ক্যা কোরত’ নামে যে দুটি শব্দ শুনা যায়, তা বিরল। তাছাড়া, সাম্পান তৈরির যে কর্মযজ্ঞ ছিল তাও কমে গেছে। সাম্পান তৈরির কারিগররা এখন ফিশিং বোট তৈরিতে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অধীনে কারিগররা ফিশিং বোট তৈরি করছেন।

চট্টগ্রামে সাম্পানকে উপজীব্য করে সমৃদ্ধ হত অর্থনীতি। সঙ্গে উৎকর্ষতা লাভ করেছে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেও। রচিত হত নানা রূপকথার গল্প, নাটক ও গান। সঙ্গে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে বর্ণিল সাম্পান। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সাম্পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোগোতে ধারণ করে চট্টগ্রামে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনুপম স্মারক হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্দনিক লোগোটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার দেশের বিখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান। চবি’র এই ধূসর রঙের লোগোটির আকৃতি অনেকটা কুলার (ধান-চাল ঝাড়ার একটি গ্রামীণ উপকরণ) মত হলেও এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের সামনের দিকের অবয়বকে কেন্দ্র করে তৈরি করা। সাম্পানের গঠন কাঠামো অনুসারে লোগোটি তৈরি করা হয়েছে। একটি শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠের লোগোতে সাম্পানকে ধারণ করায় বেড়েছে এর মান। এছাড়াও সাম্পান নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, পল্লগীতি কিংবা ভাটিয়ালি ঘরানার অনেক গানে ওঠে এসেছে সাম্পানের কথা।

সঙ্গীতজ্ঞ মোহনলাল দাশ রচিত ও শেফালী ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। এই  গানের থিম নিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছে ‘সাম্পানওয়ালা’ নামে চলচ্চিত্র। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মধ্যে মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ গানটি অনন্য এক সংযোজন। আছে ‘বাঁশখালী মইশখালী পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই চলে/তোরা কনকন যাবি আঁর সাম্পানে/কর্ণফুলীর মাঝি আঁই নিয়ুম ভাটি উজানে’, ‘কি গান মাঝি শুনাইলো/কি বাঁশি মাঝি বাজাইলো কর্ণফুলী সাম্পাওয়ালা আমার মন কাড়ি নিলো’ ‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে/অভাগিনীর দুঃখর কথা কঅবি বন্ধুরে/হক্কল সমত আইসতো যাইতো সাম্পাননান চালাই/এ ঘাট ঐ ঘাট ঘুইরতো বন্ধু ভাটিয়ালি গায়/কদিন ন দেখির তারে/আঁই মন দিলাম যারে’ শীর্ষক গানেও এসেছে সাম্পানের কথা।

সাম্পানের পেছনে খুঁটির সঙ্গে উন্নত জাতের বেত দিয়ে আংটার মতো বন্ধনী তৈরি করা হয়। সেই বন্ধনী দিয়ে খুঁটির সঙ্গে হালিশকে আটকিয়ে দেয়া হয়। মাঝি দাঁড়িয়ে দুই হাতে হালিশে চাপ দিলে বেত আর কাঠের সংঘর্ষে ‘ক্যা কোরত’ শব্দের সৃষ্টি হয়। এই ক্যাঁ কোরত নিয়েও তৈরি হয়েছে মিষ্টি-মধুর আঞ্চলিক গান। ‘সাম্পান ওয়ালা ক্যাঁ কোরত, কেনে যাইয়ুম বববুরত, বববুর জামাই থিয়াই রইয়ে ঘাঁটার দুয়ারত।’ কিংবা ‘রঙিলা মাঝিরে এ ঘাটঅদি সাম্পান ভিড়াইও’ শীর্ষক গানগুলো সাম্পানকে কালনিরবধি প্রাণবন্ত ও দেদীপ্যমান করে রেখেছে। এ গানটিতে একজন গ্রামীণ সহজ-সরল নারীর আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। সর্বোপরি সাম্পানকে উপজীব্য করে লেখা গান, কবিতা, প্রামাণ্য চিত্র চট্টগ্রামের গানের ঐতিহ্যকে নানাভাবেই সমৃদ্ধ করেছে। তবে কালের ব্যবধানে সাম্পানের সুমধুর ক্যা কোরত শব্দটি এখন ইঞ্জিনের উচ্চকিত আওয়াজে ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে।

পাঁচ.

সাম্পানের সেই জৌলুস, ব্যস্ততা এখন প্রায়ই কমে গেছে। দুই-তিন দশক আগেও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই-রাজখালী খালের বিভিন্ন ঘাট থেকে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলার যাত্রীরা নদী পথে বাড়ি ফিরতেন। যানজট আর পথের নানা ভোগান্তি ছাড়াই নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা হত। চাক্তাই-রাজাখালী এলাকার বিভিন্ন ঘাট দিয়ে পণ্য নেয়া হত চট্টগ্রামের পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী, আনোয়ারা, হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায়। জোয়ার-ভাটার তালে কম সময়েই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারত। কিন্তু এখন আর সাম্পান বা নৌকা দিয়ে যাত্রী কিংবা পণ্য পরিবহন করা প্রায়ই কমে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি-উৎকর্ষতায় সব হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও অনাদিকাল নৌকার সেই বৈশিষ্ট থেকে যাবে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া বৈশিষ্ট-বিশেষণ এতটুকু ফিকে হবে না। থাকবে চির জাগরুক।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট