চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাহাজনির্মাণ শিল্পের সূতিকাগার কর্ণফুলী

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:৪৫ অপরাহ্ণ

আলীউর রহমান

 

কর্ণফুলী নদী ঘিরেই চট্টগ্রামে জাহাজনির্মাণ শিল্পের গোড়াপত্তন সুপ্রাচীনকালে। চাঁদ সওদাগর ছিলেন অন্যতম জাহাজ রপ্তানিকারক। সেসময়ে পালে চলা কাঠের জাহাজের ছিল রমরমা অবস্থা। এখানে নির্মিত সমুদ্রগামী জাহাজ বা বাণিজ্যতরী রপ্তানি করা হতো বিশে^র বিভিন্ন দেশে। স্পেনীয় রণতরীগুলো যখন ভূমধ্যসাগর, ভারত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরে দাপিয়ে বেড়াত সেই বহরে বাংলায় নির্মিত নৌযানের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না। আর্মাড নামে পরিচিত স্পেনীয় ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী নৌযুদ্ধে চট্টগ্রামে নির্মিত বহু রণতরী স্পেনীয় বহরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। হিস্ট্রি অব ইংল্যা- থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের বিশ্ববিখ্যাত নৌযুদ্ধে চট্টগ্রামে নির্মিত সুলুপ জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ইউরোপীয় ভ্রমণকারী সিজার ফ্রেডারিক ১৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে ভ্রমণে আসেন। তাঁর বর্ণনা মতে, ‘বছরে চট্টগ্রামে তৈরি ২৫ থেকে ৩০ খানি জাহাজ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো।’

চট্টগ্রামের সরের জাহাজের নসু মালুম, আবদুল মালুম, আছাদ আলী মালুম, আকবর আলী মালুম আজো স্বনামে বিখ্যাত। সেকালের সরের জাহাজের নিরক্ষর অথচ অভিজ্ঞ মালুমেরা প্রথম যুগে আকাশের নক্ষত্র দেখে দিকদর্শন যন্ত্রের সাহায্যে জাহাজ পরিচালনা করতেন। বেতারযন্ত্র, ইঞ্জিন ও খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণব্যবস্থাবিহীন পশ্চিমে ইউরোপ, পূর্ব-দক্ষিণে চীন দেশের বন্দরে যাতায়াত করতেন। আজও তা  বিস্ময়কর হয়ে আছে।

জাহাজনির্মাণ শিল্পের অবনতি

উনবিংশ শতকের শেষ দুই যুগ থেকে চট্টগ্রামের জাহাজনির্মাণ শিল্পের অবনতি শুরু হয়। বিদেশি স্টিম জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় তাল মেলাতে না পেরে চট্টগ্রামে নির্মিত সরের জাহাজ হারিয়ে যেতে শুরু করে। সুবিখ্যাত ইংরেজ সিভিলিয়ান ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছেন, ‘১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি জাহাজনির্মাণ শিল্পে চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় ছিল। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম মহাযুদ্ধের কিঞ্চিৎ পূর্বে চট্টগ্রাম শহরে ফিরিঙ্গীবাজারের দোভাষ পরিবারের পরলোকগত আবদুর রহমান দোভাষ দু’খানি সরের জাহাজ নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর হালিশহরের আবদুল মালুমের পৌত্র আবুল খায়ের সওদাগর, কাজি আবদুল বারিক ও ফটিকছড়ি নিবাসী শশী বাবু যৌথ মালিকানায় চট্টেশ্বরী নামক একখানি সরের জাহাজ নির্মাণ করেন। সম্ভবত এটিই চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের শেষ নিদর্শন। কিন্তু তখন কলের জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে চট্টেশ্বরী মার খায়। বন্দরের পাওনা আদায় করতে না পারায় চট্টেশ্বরী নিলাম হয়ে যায়। এরপর এ যাবৎ চট্টগ্রামে আর কোন বহিঃসমুদ্রগামী সরের জাহাজ প্রস্তুত হয়নি।’

আধুনিক জাহাজনির্মাতা প্রতিষ্ঠান

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু লগ্নে পশ্চিমা কলের জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যায় চট্টগ্রামের জাহাজনির্মাণ শিল্প। কালের গহব্বরে হারিয়ে যায় হালিশহরের ঈশান মিস্ত্রীরা। ইতিহাস হয়তো তার পথ পরিক্রমায় বিবর্তন হয়ে আবারও ফিরে আসে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৮০ বছর পর ১৯৯৫ সাল থেকে চট্টগ্রামে নতুন করে গড়ে উঠে আধুনিক জাহাজনির্মাণ শিল্প। পৃথিবীর অন্যতম সুবিধাসম্পন্ন পোতাশ্রয় কর্ণফুলীর তীরে ছোট-বড় মিলে ১৬টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড, ফিসার শিপইয়ার্ড, এফএমসি ডকইয়ার্ড ইত্যাদি।

২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হান্না চট্টগ্রামে জাহাজনির্মাণ শিল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের পর বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে জাহাজনির্মাণ শিল্প। চট্টগ্রাম হচ্ছে এই সেক্টরের উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়ী অঞ্চল।

ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামে গড়ে উঠা জাহাজনির্মাণ শিল্পের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশে^। তবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও সেভাবে বিস্তার ঘটেনি। সরকারি সহায়তার অভাবে বিস্তৃতি লাভ করেনি বলে জানান উদ্যোক্তারা। নানাবিধ সমস্যা ও সংকটে ধুঁকছে ঔজ্জ্বল্য এ খাতটি। যেমন, এ শিল্পে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট করার ঘোষণা দিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু এখনো সেই ঘোষণা কার্যকর হয়নি। শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্যখাতের মধ্যে একমাত্র শিপ বিল্ডিং খাতে শুরুতে ভ্যালু এডিশনের পরিমাণের হার ৩৫ শতাংশ, যা অন্য কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে হয় না। এ শিল্পের জন্য ট্রেড ফেসিলিটি নিশ্চিত ও কার্যকর করা দরকার।

শিপ বিল্ডার্স খাতের অমিত সম্ভাবনা

বাংলাদেশের জাহাজনির্মাণ শিল্পের সুনাম ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে পৌঁছেছে। দেশি প্রযুক্তি ও লোকবল ব্যবহার করে দেশীয় ইয়ার্ডগুলোতে যাত্রীবাহী জাহাজ, অয়েল ট্যাংকার, টাগবোট, ফিশিং বোটসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক নৌযান নির্মাণে বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে।

বিশ্বে প্রতি বছর সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু জাহাজনির্মাণ শিল্প বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। ব্যবধানটির আর্থিক মূল্য ৩৩ হাজার ২৮ কোটি ডলার বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর জাহাজনির্মাণ শিল্পে যে ৩ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে তার ১ শতাংশও যদি বাংলাদেশ পূরণ করতে পারে তাহলে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলারের বাজার বাংলাদেশ দখলে নিতে পারবে। এজন্য সরকারের সহায়তা চেয়েছেন উদ্যোক্তরা।

২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাহাজনির্মাণ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। এখানকার শিপ ইয়ার্ডগুলো আয় করেছে প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকা। আগামী দু’বছরের মধ্যে এ খাত থেকে আসবে আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া এ সেক্টরে এখন যে অবকাঠামো আছে, তাতেই বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। সরকার যদি সুবিধা দেয় আগামী ৫ বছরের মধ্যে এ শিপ বিল্ডিং সেক্টর থেকে বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা আয় করার সম্ভবনা রয়েছে।

ছোট ও মাঝারি শিল্পের সম্ভাবনা

জাহাজনির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো আগামী ২০ বছরের জন্য নতুন অর্ডার নিতে পারছে না। ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলো এখন অত্যাধুনিক সাবমেরিন নির্মাণে ব্যস্ত। বিশ্বে ছোট ও মাঝারি আকারের সমুদ্রগামী জাহাজের চাহিদা থাকায় প্রধান প্রস্তুতকারক দেশগুলোর বাইরে বিকল্প খোঁজে বিশ্বব্যাপী তৎপর। এ কারণে ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশের প্রতি ঝুঁকেছেন।

‘দ্য মোটর শিপ’ ম্যাগাজিনের তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাজারে এখনো জাহাজের চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ২৫ ভাগ ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি চাহিদার বাজার মূল্য এক লাখ ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। জাহাজের বিশ্ব বাজার যদি মাত্র এক শতাংশ দখল করা যায় তাতে এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব।

পশ্চাৎসংযোগ শিল্পের বিকাশ

জাহাজ রপ্তানি করে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে, অন্যদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে সঙ্গে দেশে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের দ্বার উন্মোচিন হবে। জাহাজ নির্মাণের কাঁচামালসহ আনুষঙ্গিক যেসব জিনিসের প্রয়োজন হয়, তার বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অথচ এ শিল্পে ব্যবহৃত অনেক কিছুই দেশে প্রস্তুত করা সম্ভব। জাহাজের সাজসজ্জার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, পোর্ট হোল, ফেয়ার লিডস, ম্যাট ল্যাডার্স, সিঁড়ি, গ্যাংওয়ে, গ্রিল, ট্রলি, নিরাপত্তাসামগ্রীর মধ্যে লাইফ জ্যাকেট, লাইফবোট, রেসকিউ, নেট এসব সামগ্রী দেশেই প্রস্তুত করা সম্ভব। এগুলো ছাড়াও মেরিন লাইটিং, মেরিটাইম সাইন, সিম্বল এবং পোস্টার, নোঙর ও লোহার শিকল, বিভিন্ন ধরনের মেরিন কেবল, ইলেকট্রনিক্সসামগ্রী, সুইচগিয়ার, পিস্টন রিং, পাইপ, পাম্প, শিপ বিল্ডিং পেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী দেশীয় কারখানায় তৈরি করে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব।

 

কর্ণফুলী তীরের জাহাজনির্মাণ শিল্পের ভবিষ্যত

 

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে জাহাজনির্মাণ শিল্প জোন গড়ে তোলার বিশাল সুযোগ রয়েছে। দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টি সার্টিফিকেট পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করতে চায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জাহাজনির্মাণ শিল্পের জন্য ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করে ও ঋণের সুদ এক অঙ্কের করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সুবিধা দেয়া হয় তাহলে জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর অমিত সম্ভাবনা রয়েছে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাহাজ নির্মাণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি। এমনই একজন সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসা বাংলাদেশি কর্মী আবদুল করিম। তিনি বলেন, দেশে অর্ধেক বেতনে কাজ করেও সুখ রয়েছে। বিদেশে বেতন বেশি। কিন্তু পরিবার পরিজন নেই। দেশে চাকরির নিশ্চয়তা পেলে আমার মতো অনেকেই দেশে ফিরে আসবেন।

জাহাজ নির্মাণে কর্ণফুলীর পোতাশ্রয় ব্যবহার করে বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ একটি দেশে পরিণত করার বড় সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। এটি করা গেলে এ খাতটি এ দেশের বিদ্যমান সব ক’টি খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে প্রথম স্থানে ওঠে আসবে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের হৃতগৌরব ফিরে আসবে চট্টগ্রামের।

লেখক : সাংবাদিক ও সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস-সংস্কৃতি গবেষণাকেন্দ্র

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট