চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ছকিনার মতো স্বাবলম্বী হয়েছেন ৭ সহস্রাধিক উদ্যোক্তা

মরিয়ম জাহান মুন্নী 

২৮ জানুয়ারি, ২০২২ | ১:২৮ অপরাহ্ণ

পিতৃহীন তিন মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসারের ঘানি টেনে যাচ্ছিলেন ছকিনা বেগম। বাড়ি মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া। এমন সময় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় আলো খুঁজে পেলো ছকিনা বেগমের পরিবার। ষাটোর্ধ্ব এ নারী মিরসরাই উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় ঋণ নেন। সেই ঋণের টাকায় বাঁশ ও বেতের কাজ শুরু করেন। বলা যায়, এরপর থেকেই ঘুরে দাঁড়ান তিনি। পরবর্তীতে একের পর এক ঋণ পরিশোধ করে ঋণ নিয়ে ছাগল ও হাঁস পালন শুরু করেন।

এভাবেই ভাগ্যের চাকা তিনি। ইতিমধ্যে বিয়ে দিয়েছেন এক মেয়েকে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শুধু ছকিনা বেগমই নয়, গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম জেলায় তাঁর মত আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন আরো ১০ হাজার ৭০৬ জন উপকারভোগী। এরমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ উপকারভোগী অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার জন স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছেন বলে চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার দেয়া তথ্যমতে, উপজেলা পর্যায়ের ১৫টি এবং শহর পর্যায়ের আরো তিনটি কার্যালয়সহ চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা বিভাগে গত ১০ বছরে ১৮টি ইউনিটে পাঁচ খাতে ২৬ কোটি ৩৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সরকার।

এই বিনিয়োগের আওতায় আলোচ্য সময়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন ১০ হাজার ৭০৬ জন উপকারভোগী। সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জে এ ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ঋণগুলো মূলত পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ, পল্লী মাতৃকেন্দ্র কার্যক্রম, আশ্রয়ণ কার্যক্রমসহ শহর পর্যায়ে এসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রম এবং শহর সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় দিয়ে থাকে।

কথা হয় সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রতিবন্ধী ক্ষুদ্রঋণ খাতে ঋণগ্রহীতা রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের নদিমপুর গ্রামের বাসিন্দা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শেখ মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিনের সাথে।

ঋণ নিয়ে সফল হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ছোটবেলায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আমার দুই চোখই নষ্ট হয়ে যায়। এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনার পর দৃষ্টিগত সমস্যা আর পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে পড়াশোনা সম্ভব হয়নি। এরপরে বিয়ে করি, আমার পুরো পরিবার বড় ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। পরে আমি উপজেলা সমাজসেবা থেকে প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রমে ঋণ প্রস্তাব করি। সেই টাকায় সবজি চাষ শুরু করি। এভাবে আরো দুইবার ঋণ নিয়ে মাছ চাষ এবং কলা বাগান করি। বর্তমানে আমার মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় আসে। এছাড়া আমার দুই মেয়েই পড়াশোনা করছে। এখন পরিবার নিয়ে ভালোই আছি।

একইভাবে শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৩ থেকে হামজারবাগ এলাকার ১৩ জন নারী-পুরুষ ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। ঋণ গ্রহণকারীদের দল প্রধান নাহিদা সোলতানা বলেন, আমি প্রথমে ঋণ নিতে গেলে একটি দল গঠন করার কথা বলেন। তখন আমি এ এলাকার কিছু তরুণ-তরুণীকে নির্বাচন করি। সমাজসেবা অফিস-৩ তাদের থেকে ১৩ জনকে বেছে নেয়। আমাদের প্রতিজনকে প্রথমেই ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ দেয়। সেই টাকায় কেউ জুতা, সেলাই, ছোট করে খাবারের দোকান ও অনলাইন ব্যবসা শুরু করি। এভাবে ঋণ পরিশোধ করে আবার নতুন করে ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়াচ্ছে অনেকে। ১৩ জনের সবাই  আমরা স্বাবলম্বী এখন।

তবে ঋণ প্রদানের বিষয়ে শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৩ এর সমাজসেবা অফিসার আশরাফ উদ্দিন বলেন, আমার কার্যালয় থেকে পাঁচ বছরে দুইখাতে ২১০ জনকে ঋণ দিয়েছি। তারমধ্যে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীসহ উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষে ঋণ গ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচবছরে ঋণ দেয়া হয়েছে ৭০ লাখ টাকা এবং যেকোনো দুর্ঘটনায় দগ্ধ ব্যক্তিদের দেয়া হয় প্রায় এক লাখ টাকা। শহর পর্যায়ে এসব ঋণ নিয়ে প্রায় ৭০ ভাগ ঋণ গ্রহণকারী স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় সফল হন। বাকি ৩০ ভাগ ঋণগ্রহণকারী ঋণ নিয়ে খরচ করে ফেলেন। যেহেতু এ টাকাগুলো গরিব শ্রেণীর মানুষকে দেয়া হয় এ ক্ষেত্রে অনেকে টাকা নিয়ে পালিয়েও যায়। শহর পর্যায়ে আমরা এ ধরণে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হই।

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহীদুল আলম বলেন, প্রতি বছরই সেবার পরিধি বাড়ছে। নতুন করে দুটি সেবা বাড়ানো হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে। এছাড়াও আরো কিছু সেবা যোগ হবে। এ সেবাগুলো পাবেন, কামার, কুমার, নাপিত, মুচি, বাঁশ-বেত, কাঁসা-পিতল প্রস্তুতকারীরা। অনলাইনে জরিপের মাধ্যমে তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রথমে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এককালীন পুঁজি দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ১০-৫০ হাজার টাকা করে ঋণ দিচ্ছি। তবে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে ৫০ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত যেন ঋণ দিতে পারি সেই প্রস্তাব করেছি। এ প্রস্তাব যদি গ্রহণ করে তবে আগামীতে আমরা আরো বেশি টাকার ঋণ দিতে পারবো।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট