চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোভিড টিকা : ষড়যন্ত্র না আশীর্বাদ?

২৭ জানুয়ারি, ২০২২ | ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত বিশ্বে কোভিড ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা বেশ জোরদার, কখনো কখনো তা প্রতিবাদ এমনকি সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। গণতন্ত্রে ভালো মন্দ উভয়ের বিরুদ্ধেই ভিন্নমত থাকতে পারে। এটা গণতন্ত্রের একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাই বিষয়টি নিয়ে বেশি একটা ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ কোনো এক সামাজিক প্ল্যাটফর্মে আমার এক বন্ধুর পোস্ট দেখে বিস্মিত হলাম।
তিনি লিখেছেন “পাশ্চাত্যের শিক্ষিত সমাজ যেখানে ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে সেখানে আমরা তৃতীয় বিশ্বের জনগণ তার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি”। তিনি আরো বলেছেন, উন্নত বিশ্বের সুধীসমাজের মতো জ্ঞানী হয়ে উঠতে আমাদের আরো কয়েক দশকের প্রয়োজন। বিষয়টি আমাকে কয়েকটি কারণে চিন্তিত করে তুললো।
প্রথমতঃ পাশ্চাত্য বিশ্বের শিক্ষিত সমাজ যা চিন্তা করবে বা বলবে তা আমাদের সবসময় সঠিক মনে করতে হবে কেনো? অতীতে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে তাদের এ সমস্ত তত্ত্ব পরবর্তী কালে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ইরাকের মাস ডেস্ট্রাকশন উইপন তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
দ্বিতীয়তঃ ভ্যাক্সিন মন্দ এটি বলার জন্য আমাদের হাতে কি যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে? এ প্রসংগে বলতে হয়- আমরা আমাদের ছোটবেলার পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ২৮ বছর। সেটি আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে। যদিও আমাদের পিতা-মাতা, দাদা-দাদী অধিকাংশকেই দেখতাম তারা প্রায় ষাট বা সত্তরোর্ধ্ব। তখন একধরনের গোলকধাঁধা তৈরি হতো। পরে বুঝেছিলাম এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে।
আসল ব্যাপারটা হলো তখন শিশুমৃত্যু এতবেশি ছিলো- যা প্রতি হাজারে প্রায় ৩০০ এর কাছাকাছি। এটাই গড় আয়ু অনেক নিচে নামিয়ে রাখতো। আজ শিশু মৃত্যু ৪০ এর ঘরে নেমে এসেছে। যদিও বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, ভেজাল খাদ্য, সামাজিক চাপ, আয়েশী জীবন ও খাদ্যাভাস হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে, তবুও বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭৩।
বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার অভাবনীয় উন্নতি এই গড় আয়ু বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ। কিন্তু মূলত শিশু মৃত্যু হ্রাস এইক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
আজ স্মলপক্স এর মতো প্রাণঘাতী রোগ পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। পোলিও হুপিংকফের প্রকোপ নেই, হাম, মাম্পস, ধনুস্টংকার, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে। এটি সম্ভব হয়েছে- টিকাদান বা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে। এক সময় প্রচারণা ছিল ভ্যাক্সিনের কারণে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না কিংবা অটিজমের মতো মানসিক রোগের বৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু সেটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা বরং দেখছি আমাদের টিকাপ্রাপ্ত শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়ে সমাজে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করছে।
উন্নত বিশ্বের শিক্ষিত সুধীসমাজ এবং তাদের এদেশীয় ধ্বজাধারীরা আজ আবার কোভিড টিকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তারা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির মাফিয়াতন্ত্র আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের যুক্তি তুলছেন। কিন্তু সেটি প্রমাণের সময় এখনো আসেনি। আমরা বরং দেখতে পাই কোভিড সংক্রমণ বাড়লেও আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু অনেকটাই কমে গেছে।
সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যান্য উপায় যেমন মাস্ক ব্যবহার, হাতধোয়া, স্যানিটাইজার সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। সেখানে ভ্যাক্সিনই একমাত্র কার্যকরী পদ্ধতি। যা ভিতর থেকে সার্বক্ষণিক সুরক্ষা দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাহলে কী করবো? পাশ্চাত্য বিশ্বের অনেক ভালো দিক আছে। যা আমরা অনুসরণ করতে পারি। কিন্তু অন্ধ অনুগতের মতো শিক্ষিত সমাজের আকাশ কুসুম তত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে লাশের সারি দীর্ঘায়িত করবো নাকি ভ্যাক্সিন নিয়ে দ্রুত একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করবো।

লেখক : ডা. মো. সাজেদুল হাসান
সাবেক অতিরিক্ত সচিব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট