চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

শ্রমিকের ৪শ’ কোটি টাকা হাওয়া!

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ জানুয়ারি, ২০২২ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

­­প্রথমে রিকশা চালকদের নিয়ে গড়ে ওঠে রূপসা উন্নয়ন সমিতি। যার অবস্থান ছিল গলির ভেতরেই। কিন্তু বছর কয়েক গড়াতে নিবন্ধন পেয়েই রূপ নেয় মাল্টিপারপাসের। আর তখনই শুরু হয় লোভের টোপ। টার্গেট শুধুমাত্র গার্মেন্ট শ্রমিক। বেশি সময়ও আর প্রয়োজন হয়নি, শ্রমিকের টাকাতেই কয়েক বছর পর তা রূপ নেয় ফাউন্ডেশনে। তাতেই শুরু হয় লোপাটের খেলা। লোভের ফাঁদে ফেলে মাত্র দেড় দশকেই পাহাড় গড়ে হাজার কোটি টাকার। যার অর্ধেকের হিসেবই এখন নেই কোম্পানিটিতে।

তথ্য বলছে, নগরীর ইপিজেডকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা এখন পুরোই হাওয়া। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যই বেরিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে। ইতোমধ্যে রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের লোপাটের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, এমডিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলাও দায়ের হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাসেও গিয়েছেন ৬ জন। কিন্তু তবুও টাকা উদ্ধারতো দূরের কথা, দেদারসেই চলছে তাদের কার্যক্রম।

এদিকে বিপুল লাভতো দূরের কথা, জমা দেয়া মূল অর্থই ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়েছে সাধারণ গ্রাহক হাজারো শ্রমিককে। যদিও ইতোমধ্যে শ্রমিকরা তাদের অর্থ পেতে মরিয়া হয়ে কেউ মামলা মোকাদ্দমাতেও জড়িয়েছেন। কিন্তু টাকা উদ্ধারের বিষয়ে নিয়ে চলছে এক ধরনের তামাশা। দৃশ্যমান কোন কর্ম তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করে রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নামে এ প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে। যার অধিকাংশই ইপিজেড এলাকাকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক। এসব শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানটিতে টানতে নিয়োগ দেয়া হয় প্রায় ৫০ জন ‘সিনিয়র ম্যানেজার’ পদধারী কর্মকর্তাও। যাদের সাথে রয়েছেন একেজন নারী সহকারীও। তাদের প্রধান কাজই হচ্ছে শুধুমাত্র পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ফুসলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য পদ দেয়া। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাকা জমা রাখলেই ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশের দেয়ার গল্প শুনানো হয় তাদের। যদিও বাস্তবে তা পুরোই ফাঁকা।

তথ্যমতে, সাত জনের একটি পরিষদের মাধ্যমেই চলে এ প্রতিষ্ঠান। যার চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান কোম্পানি। ভাইস চেয়ারম্যান মুসা হওলাদার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন হওলাদার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকল্প) রাসেল হওলাদার, এজাজুল হক খান, নাছির হওলাদার ও মো. আলমগীর। যারা এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন।

ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবিরুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে পাঁচটি গ্রুপে কাজ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপের নেতৃত্বে দেন শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তা। যাদের অধীনে ছিল একাধিকজন। তারাই মূলত গ্রাহক জোগাড় করতো। একটি গ্রুপের প্রধান ছিল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। গতবছরে ৮৬ কোটি টাকাই ছিল তার আওতায়। সেই হিসেবে ধারণা হচ্ছে ২০ হাজারের বেশি গ্রাহক থেকে এ পাঁচ গ্রুপ ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। ইতোমধ্যে থানায় ও আদালতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা আছে। তাদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অন্যদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’

এদিকে, পুলিশ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও গ্রাহকদের টাকায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনেও তদন্ত চলমান রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নামে নগরীর ইপিজেডকেন্দ্রিক অন্তত ৭টি বাড়ি রয়েছে। এরমধ্যে কলসী দিঘির পাড়ের বসির আহমেদ রোডের রূপসা ভবন-৪, ওমর শাহা মাজারের পাশে, ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ ডিগ্রি কলেজের পাশে, হাসপাতাল গেট, নয়ার হাট ও বন্দরটিলা কসাই গলি, আকমল আলী রোডে রয়েছে রূপসা ভবন নামে একাধিক বাড়ি। যার একেকটি প্রতিষ্ঠান শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামেই ক্রয় করা হয়। এছাড়া পতেঙ্গা এলাকায় কিছু জমিও আছে প্রতিষ্ঠানটির।

পুলিশ ও দুদক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির এসব ভবন আর জমি দিয়েও গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির যে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার ছিল, তাও ছিল না। এ জন্য দায় এড়ানোর সুযোগও নেই নিবন্ধন দেয়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের। এরবাইরে প্রতিবছর অডিট হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা পূর্বকোণকে বলেন, ‘মূলত এসব বাড়ি আর জমির লোভ দেখিয়েই আকৃষ্ট করা হয় শ্রমিকদের। যাদের বলা হয় ৫০ হাজার টাকা জমা রাখলে আপনাকে বছর শেষে ৬০ হাজার টাকা দেয়া হবে। কিন্তু আসলেই এর কিছুই হয় না। বছর চলেও গেলেও টাকা বুঝিয়ে দেয়া নিয়ে চলে নানা প্রতারণা।’

প্রসঙ্গত : ২০২০ সালের জানুয়ারিতে টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ নানান অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। এসময় ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা জব্দসহ গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান মুছা হাওলাদার, পরিচালক গোলাম ফয়সাল ও রাসেল হাওলাদারকে। তারপর থেকেই বেরিয়ে আসছে একের পর এক তথ্য। এরমধ্যে দুই সিনিয়র ম্যানেজার কামরুজ্জামান হওলাদার ও গোলাম ফয়সালের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের হাতিয়ে নিজেদের পকেট ভারীর অভিযোগ।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট