চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঐতিহ্য হারাচ্ছে চাটগাঁইয়া শুঁটকি

২৩ জানুয়ারি, ২০২২ | ১২:০৭ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

চট্টগ্রামের শুঁটকির মুখরোচক স্বাদ-সুঘ্রাণে এখনো জিবে জল আসে রসনাবিলাসীদের। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে সেই ঐশ্বর্য বিলিয়ে দিয়েছে। রসনাপ্রিয় যে ব্যক্তি চাটগাঁইয়া শুঁটকির প্রকৃত স্বাদ পেয়েছেন, বার বার পেতে চান সেই স্বাদ। দেশি-বিদেশি অতিথিদের ভোজনবিলাসেও শুঁটকির সুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে শুঁটকির সেই স্বকীয়তা-ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ধার করা শুঁটকি দিয়ে দুধের স্বাদ  ঘোলে মিটাতে হচ্ছে। ভেজালের ভিড়েও মহেশখালী, সোনাদিয়া, রাঙাবালি ও দুবলার চর এলাকার শুঁটকি এখনো রসনাতৃপ্ত মিটাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের একমাত্র শুঁটকি-বন্দর আছদগঞ্জ থেকে দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটানো হতো। এখন দেশীয় শুঁটকির জোগান ৩৫-৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। শুঁটকির সবচেয়ে বড় মোকাম হচ্ছে আছদগঞ্জ। এখানে ৪০টি আড়ৎ ও ২৮০ টি পাইকারি দোকান রয়েছে। এছাড়াও শতাধিক খুচরা ও ভাসমান দোকান। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে শুঁটকির হাট বসে। প্রতি হাটবারে এখান থেকে অন্তত ৩০ ট্রাক শুঁটকি বেচাকেনা হয়। ট্রাকপ্রতি ১৫-১৮ টন শুঁটকি পরিবহন করা হয়। আর সপ্তাহের অন্যান্য দিন বিক্রি হয় ৫-৮ ট্রাক।

আছদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আবু নাছের পূর্বকোণকে বলেন, এক সময় এখানকার শুঁটকি দিয়ে দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদা মিটানো হত। এখন দেশীয় উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে চাহিদার ৩০-৩৫ শতাংশ মেটানো হয়। অবশিষ্ট শুঁটকি ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। সাগরে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়া ও মাছের দামবৃদ্ধির কারণে শুঁটকির জোগান কমে গেছে। তারপরও চট্টগ্রামের শুঁটকির স্বাদ-সুঘ্রাণের এখনো জুড়ি নেই।

সীমিত আকারে হলেও ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এখান থেকে শুঁটকি রপ্তানি হয়।  আছদগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘৪০টি আড়ত থাকলেও এখন ব্যবসা করছেন প্রায় ৩০ জন। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ অগ্রিম টাকা দিয়ে শুঁটকি কিনতে হয়। আর বিক্রি করতে হয় বাকিতে। এজন্য বড় পুঁজি খাটাতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যবসার উত্থান-পতনে মার খেয়ে অনেকেই টিকে থাকতে পারেনি।’

খুচরা ব্যবসায়ী মফিজুর রহমান জানান, ‘দু-তিন বছরের ব্যবধানে শুঁটকির দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আর ভালো ও উন্নতমানের শুঁটকির দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই আমদানি করা ফরমালিনযুক্ত-নিম্নমানের শুঁটকি দিয়ে শুঁটকির স্বাদ নিতে হচ্ছে।’

পাইকারি মোকামে রাঙাবালির রূপচাঁদা শুঁটকি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৫শ টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায়। আর সোনাদিয়ার রূপচাঁদা আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। তবে আমদানি করা ও নিম্ন মানের রূপচাঁদা আকারভেদে ৫শ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে। সাদা ও কালো রূপচাঁদার দামও মানভেদে তফাৎ রয়েছে। লাক্ষ্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি তিন থেকে চার হাজার টাকায়। উন্নতমানে লাক্ষ্যা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি দামে। চালদা নামের এক ধরনের মাছকে লাক্ষ্যা বলে বিক্রি করা হয়। দামেও প্রায় অর্ধেক। রাঙাবালির কোরাল ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। সোনাদিয়ার কোরাল ২ হাজার থেকে ৩ হাজার। ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে আড়াই শ থেকে ১৪৫০ টাকা দরে। তবে তা নিয়ে ক্রেতাদের বিপাকে পড়তে হয়। বড় আকারের ছুরির দাম বেশি। লইট্টা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৪শ টাকা থেকে ৮ শ টাকা পর্যন্ত।

ঈছা শুঁটকি লাল ও সাদা ভেদে ৮শ থেকে ১৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাম্মা চিংড়ি (চাম্মা ইছা) ৮৫০ থেকে এক হাজার, ফাইসস্যা ৫৫০-৭০০ টাকা, পোপা শুঁটকি ৪৫০-৭০০, রিসকা শুঁটকি ৪০০-৭০০, চাপা সুরমা ৩৫০-৫০০, বোয়াল শুঁটকি ৫৫০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি আড়তে ২০-২৫ প্রকারের শুঁটকি পাওয়া যায়। তবে মান-আকার ও উৎপাদন এলাকা নিয়ে শুঁটকির দামেও তফাৎ রয়েছে। আর মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভারত থেকে আমদানি করা শুঁটকির দাম কেজিতে ২-৩শ বা তারও কম দামে বিক্রি হয়। এতে আসল শুঁটকির স্বাদ পাচ্ছেন না রসনাবিলাসীরা। শুঁটকির স্বাদ ও সুঘ্রাণে তৃপ্ত হচ্ছে না।

কক্সবাজার, টেকনাফ, সুন্দরবন, সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলার চর, কুয়াকাটা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, সোনাদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে শুঁটকির স্বাদ পৃথিবীর আর কোন শুঁটকিতে পাওয়া যায় না।

আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতি জানান, কয়েক বছর আগেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশীয় শুঁটকির বড় অংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। দেশের ৩০টি প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শুঁটকি রপ্তানি করতো। ২০০১-০২ অর্থবছরে শুঁটকি রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার মে. টন। ২০১১-১২ অর্থ বছরে শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৫০ মে. টন। বর্তমানে উল্টো আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট