চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

স্মরণ : চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী

অনলাইন ডেস্ক

১ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১১:৪০ অপরাহ্ণ

আজ চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ৭৭তম জন্মদিন। ১৯৪৪ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে পিতা হোসেন আহমদ ও মাতা বেদুরা বেগমের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের অনেকগুলো বছর নির্ঘুম চোখ আর নির্ভেজাল ভালোবাসা দিয়ে মানবসেবা করেছেন তিনি। একজন মানবতাবাদী নেতার কথা যদি লিখতে হয় তাহলে মহিউদ্দীন চৌধুরীর নাম সবার আগে আসে।

‘৬০ এর দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা। ‘৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ও ‘৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ‘৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলনে মরহুম এমএ আজিজ ও জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেন তিনি। ‘৬৮ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হলে তাঁর সাথে সভাপতি ছিলেন বাঁশখালীর কৃতিসন্তান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ। ‘৬৯ এর গণ-আন্দোলনে শহর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। ‘৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। ‘৭১ এর মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন।

একাত্তরে গঠন করেন জয়বাংলা বাহিনী। সে সময় গ্রেফতার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে উত্তর প্রদেশে তাজুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দীন চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন শ্রমিক  রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যুবলীগের নগর-কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

‘৭৫ এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুজিববাহিনী গঠন করেন। এই সময় চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলার আসামী করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতা চলে যান এবং ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। সেই সময় অনেকে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে খন্দকার মোস্তাক আর জিয়ার সাথে আঁতাত করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িকভাবে ফায়দা নিয়েছিলেন।

নীতি আদর্শের প্রশ্নে অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি এই বীর। মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বারবার কারানির্যাতন ভোগ করেন। খন্দকার মোস্তাক আর জিয়ার দুঃশাসনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারা অন্তরীণ ছিলেন তিনি। ৮০’র দশকে চট্টগ্রামের শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর সাথে সভাপতি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক মন্ত্রী মরহুম এমএ মান্নান। ১৯৮৬ সালে নিজ এলাকা রাউজান থেকে প্রথম দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদের ভোট ডাকাতি ও চর দখলের মত কেন্দ্র দখল করে নির্বাচিত হলেন যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী।

থেমে ছিলেন না মহিউদ্দীন ভাই। ’৯১ সালে কোতোয়ালী আসন থেকে আবারো মনোনয়ন পেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বাকশাল থেকে কাস্তে মার্কায় নির্বাচন করলেন সিরাজ মিয়া। ভোটের হিসাব নিকাশে আবারো পরাজিত হলেন মহিউদ্দীন ভাই। ১৯৯৩ সালে বন্দরটিলা ট্রাজেডির কথা আমরা অনেকেই জানি নৌবাহিনীর সাথে এলাকার সাধারণ মানুষের একটি সংঘাতে বহুলোক হতাহত হয়েছিলেন। সেই সময় নিহত মানুষের লাশ দাফনসহ সবধরণের কাজে মহিউদ্দীন চৌধুরী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। সেই কর্মকান্ডে দেশজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত করলেন ক্ষমতাসীন বিএনপি ও চার দলীয় জোটের প্রার্থী এড. মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনকে। খুশীর বন্যায় ভাসছিলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনকালীন সময়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে নাগরিক কমিটির উদ্যোগে মহিউদ্দীন ভাইয়ের নির্বাচনী সভা হয়েছিল। সেই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভাপতি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং আরো উপস্থিত ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, ওবায়দুল কাদের, আফম বাহাউদ্দীন নাসিম, ইসহাক মিয়া, নুরুল ইসলাম বিএসসি আইভী রহমানসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মামুন ও যুবলীগ নেতা এমএ মোনায়েমসহ স্থানীয় আওয়ামী, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। সভাটি পরিচালনা করেছিলাম আমি। মহিউদ্দীন ভাই শুধু রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সৃজনশীল রাজনৈতিক কর্মী গড়ার কারিগর। কখনও গালি দিতেন আবার কখনো আদর করে কাছে ডেকে নিতেন এই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

২০০৭ সালে ৭ মার্চ মহিউদ্দীন চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ১৯ মাস কারানির্যাতন ভোগ করে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঐ সময় তাঁর মেয়ে টুম্পা ব্যাংককে একটি হাসপাতালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। ২০০৮ সালের ১৮ অক্টোবর টুম্পা মৃত্যুবরণ করেন। মেয়ের অকাল মৃত্যুতে নির্বাক হয়ে যান তিনি। মহিউদ্দীন ভাই বলেছিলেন- সন্তান হারানোর বেদনা আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন মহিউদ্দীন ভাই। খালিমুখে ঘরে থেকে কোন মেহমানকে যেতে দিতেন না তিনি। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের মেহেদীবাগস্থ বেসরকারী প্রাইভেট হাসপাতাল ম্যাক্সে রাত ১২টার পর তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মহিউদ্দীন চৌধুরীর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর কোন বিকল্প নাই। চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। বহুমাত্রিক রাজনীতিক ও মেধাবী রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টি করার সুনিপুণ কারিগর ছিলেন মহিউদ্দীন ভাই। তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মকান্ড রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য আদর্শের পাঠশালা হয়ে থাকবে। মহান রাব্বুল আমীনের দরবারে এই দোয়া করি, তিনি যেন মহিউদ্দিন ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।

লেখক: মোহাম্মদ খোরশেদ আলম শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট