চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

এক সেতুই পাল্টে দিচ্ছে নানিয়ারচরবাসীর জীবন

ইফতেখারুল ইসলাম

১ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১২:৪০ অপরাহ্ণ

মাত্র ৫শ মিটারের (আধা কিলোমিটার) একটি সেতু বিশাল একটি জনপদের জীবনমান পাল্টে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানাভাবে জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে রাঙামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার অর্ধলক্ষ মানুষের। উঠছে পাকা ঘর। পাকা হচ্ছে সড়ক। ভরা বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে যেখানে নদী পার হওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সেতু হয়ে যাওয়ায় এখন সেই নদী পার হওয়া মিনিটের ব্যাপার মাত্র। সেতুটি সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, দীর্ঘদিন পর তাদের সুদিন ফিরছে। নানিয়ারচর এলাকা হল ঊর্বর একটি জনপদ। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লিচুসহ এখানে দেশীয় ফলের ব্যাপক উৎপাদন হয়। তাছাড়া নানা ধরনের সবজিতে কৃষকের ক্ষেত ভরে উঠে। একমাত্র চেঙ্গী নদীর কারণে কৃষকেরা ফসলের দাম পেত না। নানা কষ্টে দুর্গম পথ বেয়ে বাজারে অল্প ফসল নিয়ে পৌঁছতেই ঘাম ঝরে যেত। পরিবহন ব্যয়ও ছিল অনেক বেশি। নানিয়ারচরের বাসিন্দা, আকির্মিডিস মারমা, হ্লা হ্লা চাকমাসহ একাধিক ব্যক্তি পূর্বকোণকে জানান, একসময় এক থুরং ফসল বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে সারাদিন চলে যেত। বাজারে ফসল একবার নিয়ে গেলে তা ফেরত আনার সুযোগ ছিল না। যেকারণে দাম কম হলেও তারা বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। এখন সেতু নির্মাণের ফলে ট্রাক নিয়ে ব্যাপারিরা সরাসরি এখানে আসার সুযোগ পাবেন। ক্ষেত থেকেই ফসল বিক্রি করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করতে পারছেন তারা। যেহেতু গাড়ি আসা-যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাতে তারা সহজেই নির্মাণ সামগ্রী আনতে পারবেন। অনেকেই এখানে পাকা বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছেন। তাদের সন্তানেরা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। রোগীদের সহজেই সদর হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তারা জানান, অর্ধ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটিই নানিয়ারচর এলাকার অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কাছে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু।’ এই সেতুর উদ্যোগ নেয়ার জন্য তারা সরকারকে এবং বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু ১০ কিলোমিটার সড়কে চেঙ্গী নদীর উপর নানিয়ারচর সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষাকালে যখন কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর বৃদ্ধি পায় তখন অতিমাত্রায় ঢেউয়ের কারণে দেশীয় ইঞ্জিনচালিত নৌযানগুলোর চলাচল বন্ধ থাকতো। অপরদিকে, গ্রীষ্মের সময় পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে তাও নৌযান চলাচল বাধার সম্মুখীন হতো। দুই পরিস্থিতিতেই এক প্রকার রাঙামাটি সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতো এই জনপদের মানুষ। এমনকি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়লেও তাদের হাতে বিকল্প কোন পথ ছিল না। একারণে বছরের বেশির ভাগ সময় নানিয়ারচর এলাকার মানুষকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। সূর্য একটু হেলে পড়ে সন্ধ্যা নামলে তো সদর হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টি চিন্তাই করতে পারতো না। কারণ অন্ধকারে নৌযান চালানো আরো কঠিন। পার হতে না পেরে অনেক গর্ভবতী মাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ বয়স্ক কত রোগীর পরিবারকে মূল্য দিতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুগের পর যুগ এই জনপদের মানুষ এভাবেই চরম কষ্টের মধ্য দিয়ে সদরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। শান্তি চুক্তির পর তাদের যোগাযোগের কষ্টে লাঘবে উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির একটি অংশ হিসেবে এই সেতুটি সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। প্রকল্পটির মূল কাজ চেঙ্গী নদীর উপর ৫শ মিটার পিসি গার্ডার সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এর সাথে রয়েছে ২.২০ কিলোমিটার এপ্রোচ সড়ক। এর সাথে রয়েছে নদী রক্ষার কাজ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেতুটি নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য হল রাঙামাটি জেলা সদরের সাথে লংগদু উপজেলা হয়ে মারিষ্যা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা। এই সেতু নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। একইসাথে এই জনপদের অধিবাসীদের জন্য রাঙামাটি জেলা সদর ও বিভাগীয় সদর চট্টগ্রামের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সেতুটির নির্মাল ব্যয় ছিল ২২৭ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক ছিলেন কর্নেল মুহম্মদ সাইফুর রহমান। অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক ছিলেন লে. কর্নেল মো. আমজাদ হোসেন দীদার এবং প্রকল্প কর্মকর্তা ছিলেন মেজর সৈয়দ রিয়াসত আজীম।

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট