চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদ্রাসা রক্তাক্ত

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ

২৩ অক্টোবর, ২০২১ | ১২:৩০ অপরাহ্ণ

থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভোরে অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় ৬ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আহত হয়েছে আরো ১০/১৫ জন। এ ঘটনায় অস্ত্রসহ মুজিবুর রহমান নামে ১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। অপরাধীদের ধরতে ক্যাম্পগুলোতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। শুক্রবার (গতকাল) ভোরে উখিয়ার ১৮ নং ক্যাম্পের ব্লক এইচ-৫২ এর জাফরইজ্জা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আরসা বনাম আরএসও মতাদর্শ, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মূলত এ ঘটনার সুত্রপাত বলে স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি।

নিহতরা হলেন- রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১২, ব্লক-জে-৫ এর বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ মো. ইদ্রিস (৩২), ক্যাম্প-৯ ব্লক-১৯ এর মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর ছেলে ইব্রাহীম হোসেন (২৪), ক্যাম্প-১৮, ব্লক-এইচ-৫২ এর নুরুল ইসলামের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের ভলান্টিয়ার আবুল হোসেনের ছেলে মো. আমীন (৩২)।

এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ‘এফডিএমএন’ ক্যাম্প-১৮, ব্লক-এফ-২২ এর মোহাম্মদ নবীর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), এফডিএমএন ক্যাম্প-২৪ এর রহিম উল্লাহর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫)।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি শিহাব কায়সার খান বলেন, অস্ত্রসহ মুজিবুর রহমান নামে একজনকে আমরা আটক করেছি। শুক্রবার (গতকাল) ভোররাতে ‘এফডিএমএন’ ক্যাম্প-১৮ এইচ-৫২ ব্লকে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারীরা হামলা চালায়। হামলায় মাদ্রাসায় অবস্থানরত ৪ জন মারা যায়। ঘটনা জানতে পেরে ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্প-১২ এর পুলিশ সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধারপূর্বক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৩ জন মারা যায়। এসময় পুলিশ হামলাকারীদের একজনকে একটি দেশীয় লোডেড ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। ঘটনার পরপরই ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্প-১২ এর পুলিশ সদস্যরা মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় ব্লক রেইড পরিচালনা করে আসছে’।

খবর পেয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে জেলা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ৭টি মৃতদেহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে উখিয়া থানায় আনা হয়েছে। সেগুলো কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হবে ময়না তদন্তের জন্য। এ ব্যাপারে থানায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।

 

প্রত্যাবাসন শুরুর বিকল্প নেই

মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অবস্থানের এখন পাঁচ বছর চলছে। এই পাঁচ বছরে ছোট ছোট অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বড় ঘটনা হলো – রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড। এটা সংঘটিত হওয়ার পর অনুমান করা যাচ্ছিলো – একটা প্রতিক্রিয়া হবে। সেই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে গতকাল শুক্রবার সকালের হত্যাকা-। এই যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, এটাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে অশান্ত করে তুলেছে। এখানে তৃতীয় কোনো শক্তি যদি ইন্ধন যুগিয়ে থাকে তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

মূলত হতাশা থেকেই রোহিঙ্গারা হানাহানিতে জড়াচ্ছে। ১০-১১ লাখ মানুষ যখন দীর্ঘদিন এক জায়গায় বন্দী দশায় থাকে – তখন তাদের মধ্যে হতাশা চলে আসে। কারণ প্রত্যাবাসন নিয়ে কেউ তাদের কোনো আশা দেখাতে পারছে না। তারা দেখছে – তাদের বাড়ি-ঘরে ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে না। তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। হতাশাগ্রস্থ হয়ে তারা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের করণীয় হচ্ছে- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও জোরালো সমর্থন আদায় করা। যেসব বড় বড় দেশ মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করতে পারবে – তাদের বুঝানো। তাদের বলতে হবে – রোহিঙ্গারা মারামারি বা হানাহানিতে যেভাবে জড়াচ্ছে – এটা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন তোমাদের সার্থও বিঘ্নিত হতে পারে। এরকম হলে পরিস্থিতির দায়-দায়িত্ব আমরা নেব না। সুতরাং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতেই হবে।

 

নিরাপত্তা ঢেলে সাজানো উচিত

অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন

রোহিঙ্গা গবেষক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো রয়েছে- তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের কার্যক্রম চলছে। আধিপত্য বিস্তারের একটি চেষ্টা তাদের মধ্যে রয়েছে। সীমান্তকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলছে। ইয়াবা, অস্ত্র, শিশু পাচার থেকে শুরু করে নানা অবৈধ অর্থনৈতিক কাজ সেখানে হচ্ছে। এসব অবৈধ অর্থনৈতিক কাজে কর্তৃত্ব স্থাপন করার প্রবণতা থেকে তারা সংঘাতে জড়াচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আসে তখন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সার্ভাইব করা। টিকে থাকা। বেঁচে থাকা। সব কিছু তারা পেয়েছে। এখন তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ইস্যু নিয়ে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তৈরি হয়েছে। এসব কারণেই মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হানাহানির ঘটনা বাড়ছে। হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। এই যে হানাহানি বা হত্যাকাণ্ড এসব কিন্তু অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের করণীয় হচ্ছে – রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরৎ পাঠানো। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তত্বান্বিত করা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার যে ট্রেডিশনাল সিস্টেম – পুলিশিং বা পেট্রোলিং সেটাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প বা শরণার্র্থী ক্যাম্পের চরিত্রের সঙ্গে এডযাস্ট করে রিমডিউলিং করা। সনাতন নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যে চরিত্র – সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তা ঢেলে সাজানো।

 

সংকট দূর করতে হবে

রেজাউল করিম চৌধুরী

নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট

ক্যাম্পে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৪ হাজার রোহিঙ্গা থাকে। এমন পরিবেশে মানসিকভাবে একজন লোক সুস্থ থাকতে পারে না। ঐতিহাসিক কাল থেকেই এই অঞ্চল চোরাকারবারিদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে শুধু রোহিঙ্গারা নয়, আমাদের দেশের লোকও জড়িত। সেগুলো নিয়েও দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। এই পরিস্থিতিতে এই জিনিসগুলো (মারামারি, হত্যাকা-) হওয়ার পেছনে আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় আছে বলে মনে করি না।  তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী। আইনশৃঙ্খলা খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেটা হচ্ছে না- রোহিঙ্গাদের ভেতরে নিজস্ব কোনো ইনস্টিটিউশন নেই। তাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। স্ট্রং লিডার নাই। এটা মৌলিক সংকট। এটা দূর করতে হবে। এই কারণে রোহিঙ্গাদের ভেতরে নিজস্ব ইনস্টিটিউশন এবং লিডারশিপ ডেভেলপের জন্য কাজ করা উচিত।

তাদের মধ্যে বিভেদ যেন তৈরি না হয় – সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। এভাবে হানাহানি করলে যে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি হবে – সেটা তাদের বুঝানো উচিত। তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মোটিভেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। কায়মনোবাক্যে তাদের বলা উচিত – একদিন তোমাদের চলে যেতেই হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট