চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

ভোগ্যপণ্যে নাভিশ্বাস : শুল্ক ছাড়ের সুফল পান না ভোক্তা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১৫ অক্টোবর, ২০২১ | ১২:৪৭ অপরাহ্ণ

বেসরকারি চাকরিজীবী কামাল উদ্দিন। সচরাচর বাজার-সওদা করেন না। গত মঙ্গলবার বাধ্য হয়ে যেতে হয় চকবাজার কাঁচা বাজারে। এক কেজি মুরগি, আধা করে টমেটো, মিষ্টি কুমড়া ও এক কেজি আলু কিনেন। মুরগি আর সবজির দামে তার যেন পিলে চমকানো অবস্থা। কারণ এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে অন্তত ৩০ টাকা, সোনালি মুরগির দাম ৬০ টাকা বেড়েছে। আর কয়েক পদের সবজির দাম বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি।

এরপর মুদির দোকানে গিয়ে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনির দামে মাথায় বাজ পড়ে। বাজারের এ নৈরাশ্য পরিস্থিতিতে তিনি বলেন, ‘খাবো কী, সংসার চালাবো কীভাবে ?’ কারণ গত দুই বছরে তার বেতন এক টাকাও বাড়েনি। কামাল উদ্দিন বলেন, ‘মাসে রুটিনমাফিক সংসার চালাতে হয়। সবখানেই খরচ বেড়েছে। কিন্তু আয়-উপার্জন তো বাড়েনি।’

গতকাল ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে আটা-ময়দা কিংবা কাঁচা সবজি, মাছ, মুরগি, ডিমের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষজনের নাগালের বাইরে। সব পণ্যের জন্য বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

চাল আমদানির শুল্ক কমানো : চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি শুল্কহার কমিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। গত ১২ আগস্ট মাসে আমদানি শুল্ক আবারো কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এতেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। সরকারের শুল্ক সুবিধায় চাল আমদানি করে বাজার অস্থির করেছে একটি সিন্ডিকেট।

দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতায় শুল্ক হ্রাসের পদক্ষেপ নিলেও এই ছাড়ের সুফল ভোক্তারা পাবেন এমন গ্যারান্টি দিতে পারছে না কেউ। এমনকি চালের উপর শুল্ক হ্রাসের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোন প্রভাব না পড়ায় আরো ভোগ্যপণ্যে ছাড় দিলে যে  সেসব পণ্যের দাম কমবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘শুল্ক কমানোর পর সরকার চুপ মেরে বসে থাকে। আর কোনো তদারকি করা হয় না। তাই এর সুফল ভোক্তা ভোগ করতে পারেন না।’ শুল্ক কমানোর টাকা ব্যবসায়ীদের পেঠে যায়।

চালের পাইকারি মোকাম পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, বাজার উঠে গেলে তা আর নামানো যায় না।’

খুচরা বাজারে আতপ চাল (মোটা) বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৮ টাকা। মাসখানেক আগে তা ছিল ৪০-৪৪ টাকা। বেতি-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা। তা ছিল ৪৫-৪৬ টাকা। জিরাশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা যা আগে ছিল ৫৮-৬০ টাকা। সব ধরনের সিদ্ধ চালেও এক মাসের ব্যবধানে ৫ টাকা করে বেড়েছে।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘চালে শুল্ক কমানোর সুফল মিলেনি। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী, মিল মালিক ও মজুতদার সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।’

শুল্ক কমল পেঁয়াজ-চিনি আমদানিতে : বাজারে পেঁয়াজ ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার এ শুল্ক কমানো হলো।

তেল ও চিনির বাজার পরিস্থিতি : ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারও দীর্ঘদিন ধরে বেসামাল অবস্থা। মাসখানেক আগে তেল ও চিনির কর কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে, ব্যবসায়ীরা উল্টো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে।

খুচরা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৭৮ টাকা দরে। মাসখানেক আগে তা ছিল ৬৫ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন (৫ লিটার) মানভেদে ৬৯০ টাকা থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তা ছিল ৬৭৫ থেকে ৬৯০ টাকা। এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা। আগে ছিল ১৩০ টাকা। খোলা সয়াবিন লিটারে ১৩৫ টাকা টাকা থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাম তেল ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী ও আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও তেলের দাম বাড়ছেই। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে।’

পেঁয়াজে শুল্ক কমলেও প্রভাব পড়ে না

খাতুনগঞ্জে গতকাল ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৫৫-৫৬ টাকা। মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪০-৪২ টাকা। দেশি পেঁয়াজের ৬৫ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে দাম ২০-২৫ টাকার বেশি বেড়েছে। তবে বিকেলে পেঁয়াজের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা কমে যায়। আর রসুন ৬০-৬৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯৫-৯৬ টাকা দরে। আদা ৯০-৯৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জের আড়তদার জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘ভারতে বন্যা ও বৃষ্টি পেঁয়াজের চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে দেশীয় বাজারে প্রভাব পড়েছে। পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য ৪২০ ডলার থেকে বেড়ে ৬৪০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শুল্কহার কমানোর পরও পেঁয়াজের দাম কমার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা ভারতীয় ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও বাজার চাহিদার ওপর নির্ভর করছে।’

চাল, ডাল, তেল, চিনির সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে আটা, ময়দা, মুরগি, ডিমের দামও। খুচরা বাজারে আটা বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৩৬-৩৮ টাকা। তা ছিল ৩২ টাকায়। ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়। তা ছিল ৪০-৪২ টাকা। মসুর ডাল মাসের ব্যবধানে ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা, মটর ডাল ৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬ টাকা, মটর ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট