চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দূরের দৃষ্টি হারাচ্ছে শিশুরা

ইমাম হোসাইন রাজু

১৪ অক্টোবর, ২০২১ | ১২:০৪ অপরাহ্ণ

নগরীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারিন। মাত্র ১০ বছর বয়সী এ শিক্ষার্থীর কিছুদিন ধরেই দূরের বস্তু দেখতে সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসকের পরমার্শ নিতে গিয়ে জানা গেল অতিরিক্ত মোবাইলে আসক্ত থাকায় এ সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে। তাই চিকিৎসকও তাকে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। গতকাল পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে ফারিনের মা জানান, লকডাউনের মধ্যে বাসায় দিনের বড় অংশই মোবাইল ব্যবহার হয়েছে ফারিনের। দূরের দৃষ্টি ঝাপসা ছাড়াও মাঝে মধ্যে মাথা ব্যথা ও চোখ ব্যথাও অনুভব হতো তার। শুধু ফারিন নয়, চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, হাসপাতালটির শিশু চক্ষু বিভাগে গেল কয়েকমাস ধরে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। যেখানে কোভিডের আগে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু চমশাজনিত কারণে সেবা নিতে আসতো, সেখানে বর্তমানে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশুই আসছে মাথা ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, চোখের দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পাওয়া, দূরের জিনিস কম দেখা, চোখের পানির পরিমণা কমে যাওয়ার (ড্রাই আই) এ পাঁচ সমস্যা নিয়ে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস অতিরিক্ত ব্যবহারে কারণেই এমন সমস্যা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘসময় ধরে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে এর প্রভাব শিশুদের মধ্যে খুবই ভয়াবহ। মোবাইলসহ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের কারণে শিশুদের স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তিও দ্রুত লোপ পায়। পাশাপাশি মানসিক সমস্যাসহ শারীরিকভাবেও সমস্যায় ভুগতে পারে তারা।
সম্প্রতি বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের ২১ জেলায় ১ হাজার ৮০৩ জন শিক্ষার্থীর ওপর চলানো এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৮ ভাগ শিক্ষার্থী দিনে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে, ৯ ভাগ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে এবং ৮ ভাগ ট্যাবে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে থাকে। চলতি মাসের শুরুতে গবেষণাটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা উইলি এর হেলথ সায়েন্স রিপোর্ট জার্নালে প্রকাশিত হয়। তাতে আরও দেখা যায়, যেখানে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীরা ডায়রিয়া, চুলকানি, পেট ব্যথা, জ্বর ও সর্দি সবচেয়ে বেশি প্রকট ছিল। কিন্তু গেল দেড় বছরে তথা কোভিডকালে মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষন্নতা ও খিটখিটে মেজাজ এবং জ্বর সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে ঘরবন্দী হয়ে থাকা ও গেজেটের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন গবেষকরা।
পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বলেন, চোখে কম দেখা যাওয়া নিয়েই আগে সবচাইতে বেশি রোগী পাওয়া যেত। কিন্তু ইদানিং রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সমস্যার সংখ্যাও বেড়েছে। এখন যে রোগীগুলো পাচ্ছি, তাতে মাথা ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, চোখের দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পাওয়া, দূরের জিনিস কম দেখা, চোখের পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার সমস্যা নিয়েই বেশি রোগী আসছে। মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করে দেখা যায়, তারা কোন না কোনভাবে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ এসব বেশি ব্যবহার করেছেন। এতে করেই এ সমস্যা পড়তে হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, অনেক দূর থেকে টেলিভিশন দেখলেও, মোবাইল, ট্যাব ও ল্যাপটপ দেখতে হয় খুব কাছ থেকেই। আর এতে করে চোখের ওপর একটা তীব্র চাপ তৈরি হয়। এর কারণে চোখের উপর স্বাভাবিকের চেয়ে ৩/৪ গুণ চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে দ্রুত চোখের দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যা শুরু হতে থাকে। এক্ষেত্রে শিশুদেরই বেশি সমস্যা তৈরি হয়। হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে যত শিশু আসে, তাদের হিস্ট্রি বলে, দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ব্যবহারের কারণেই তারা এ সমস্যায় ভুগছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

পরিবারকে শিশুদের সময় দিতে হবে

প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

শিশুদেরকে মোবাইল, ল্যাপটপ জাতীয় ডিভাইস থেকে ফেরাতে অব্যশই পরিবারকে শিশুদের প্রতি যতœবান হতে হবে। শিশুদের প্রতি সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের হাতে বিভিন্ন গল্পের বই তুলে দেয়ার পাশাপাশি শিশুদের সঙ্গে বাবা-মায়েরা গল্প করতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে অবসর সময়ে আড্ডার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখনকার মায়েরা শিশুকে খাওয়াতে বা কান্না বন্ধ করতে হলেও শিশুর সামনে মোবাইলে কার্টুন বা ভিডিও দিয়ে দিচ্ছে। এটি মোটেও করা যাবে না।

সমাজ বিজ্ঞানী ও সাবেক উপচার্য, চবি

নিয়মিত চোখের পরীক্ষা জরুরি

ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভি

ডিভাইস ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। যদি অনেকক্ষণ তা ব্যবহার করতেই হয়, সেক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ মিনিট পরপর কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেয়া যেতে পারে। শিশুদের বাইরে যাওয়া, খেলাধুলা, বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একেবারেই সম্ভব না হলেও, বাড়ির ছাদে খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দেয়া জরুরি। একই সঙ্গে তাদের ভিটামিন জাতীয় খাবার দেয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চোখের সমস্যা থাকুক বা না থাকুক অন্তত কিছুদিন পর চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া ভালো।

চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল অফিসার
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়

 

 

পূর্বকোণ/এসি

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট