চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জোটেনি সরকারি স্কুল-কলেজ

পতেঙ্গা হালিশহরবাসীর সুখ-দুঃখ -শেষ পর্ব সরেজমিন হ সরকারি দুটি স্কুলের একটি হবে হালিশহরে

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও আল-আমিন সিকদার

১১ জুলাই, ২০১৯ | ২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

পতেঙ্গা আর হালিশহরের মানচিত্র নদী বা সাগরের ঢেউয়ের মতো। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনও ঢেউয়ের মতো, উথাল-পাতাল। একদিকে সারি সারি উন্নয়ন আর অন্যদিকে নাগরিকেরা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একটি সরকারি স্কুল-কলেজ নেই বিশাল এই জনপদে।
সিটি কর্পোরেশনের উত্তর-মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা পাঁচটি ওয়ার্ডে ১৯ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। শহরের বাসিন্দাই যাদের সার। নাগরিক ও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এখানকার মানুষেরা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এখানকার বাসিন্দাদের কাছে অধিকার নয়, স্বপ্ন। পণ্য হিসেবে অধিক মূল্যে কিনতে হয়। অথচ এখানে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, নৌবাহিনীর জরুহুল হক ঘাঁটি, দুটি ইপিজেড, জ্বালানি তেল স্থাপনা, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেদিক দিয়ে নগরীর সমৃদ্ধি এলাকা এটি। অথচ শিক্ষা-দীক্ষায় অনুন্নত, পশ্চাদপদ জনপথ। তবে এই জনপদে একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায় রয়েছেন বাসিন্দারা।
নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় বসবাসরত শিক্ষার্থীর জন্য নেই একটি সরকারি কলেজ কিংবা উচ্চ বিদ্যালয়। তবে এই এলাকায় নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও বেপজা কর্তৃক পরিচালিত কয়েকটি মানসম্মত স্কুল ও কলেজ থাকলেও সেখানে পড়াশোনা ব্যয়বহুল। অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর যাদের সন্তানেরা এসব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তাদের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় অনেক অভিভাবকের। তাই সরকারি কলেজ ও স্কুলে পড়াশোনার জন্য প্রতিদিন কয়েক’শ শিক্ষার্থীকে আসতে মধ্য নগরে। জামালখান, চকবাজার, নাসিরাবাদ, মাদারবাড়িসহ নগরীর শিক্ষা প্রসারিত এলাকার। ১৫ কিলোমিটারের বেশি পথ মাড়িয়ে শত কাঠখড় পেরিয়ে যাতায়াত করতে হয় তাদের।
তবে এলাকাবাসীর জন্য সুখবর হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরী আরও দুটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যার একটি হবে বৃহত্তর হালিশহর এলাকায়। বে-টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকায় স্কুলের জন্য ভূমি নির্বাচন করা হচ্ছে বলে জানান জেলা শিক্ষা অফিসার জসিম উদ্দিন।
বন্দর, পতেঙ্গা ও হালিশহর এলাকায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও কলেজ রয়েছে হাতেগোনা দুটি। ৩৯ নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে ব্যারিস্টার সুলতান আহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়। ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে পতেঙ্গা মহিলা কলেজ। মহিলা কলেজটি সিটি করপোরেশন পরিচালিত। দুটি কলেজই এখানকার উচ্চ শিক্ষার একমাত্র ভরসা। এছাড়াও ৪০ নং ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩৮ নং ওয়ার্ডে একটি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। জনসংখ্যা ও শিক্ষার্থীর হিসেবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুবই অপ্রতুল।
সরকারি মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী মো. ফারুক জামির বলেন, ‘বন্দর থেকে পতেঙ্গা এলাকার মধ্যে একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল কিংবা কলেজ নেই। তবে এই এলাকায় নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও বেপজা পরিচালিত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও ব্যয় বহন করা সম্ভব না। এই এলাকায় সরকারি কোনো কলেজ না থাকায় সরকারি মহসীন কলেজে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু যানজটের কারণে কলেজে যাওয়া ব্যাহত হয়। পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই এলাকার অসংখ্য শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগের কারণে পড়াশোনায় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
৩৯ নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার একেবারেই অপ্রতুল। নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যয়বহুল হওয়ার সাধারণ মানুষের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বৃহত্তর পতেঙ্গা ও হালিশহরের পাঁচটি ওয়ার্ডে ১৯ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। কিন্তু সরকারি কোন বিদ্যালয় নেই এই অঞ্চলে। সরকারি স্কুলে পড়াশোনার জন্য বহু শিক্ষার্থীকে নগরীর মধ্য অঞ্চলে আসতে হয়। নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি মুসলিম হাই স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বহু শিক্ষার্থী ওই অঞ্চল থেকে আসে।
নাসিরাবাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসমত জাহান বলেন, ‘এই স্কুলে হালিশহর ও বন্দর এলাকার অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। বহু কাঠখড় আর যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ওই অঞ্চলে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় প্রতিদিন হাজারো দুর্দশা-দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।’ তিনি আরও বলেন, ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা স্কুলেও ওই এলাকার অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে।
একই কথা বললেন নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদুল আলম হোসাইনী। তিনি বলেন, সরকারি স্কুলে পড়াশোনার জন্য পতেঙ্গা ও হালিশহর এলাকার শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা হচ্ছে এই অঞ্চলের স্কুলগুলো। নাসিরাবাদ, মুসলিম হাই স্কুলসহ এখানকার সরকারি স্কুলগুলোতে কয়েকশ শিক্ষার্থী রয়েছে ওই এলাকার।
৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন বলেন, পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। অনার্স (সম্মান) শ্রেণি পাঠদান শুরু করার জন্য ইতিমধ্যেই দুটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরেকটি ভবন। ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়র সাহেব।
পতেঙ্গা ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. এহতেশামুল হক বলেন, ‘প্রতিটি থানায় একটি করে মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা ছিল সরকারের। কিন্তু নগরীর পতেঙ্গা, বন্দর, ইপিজেড ও হালিশহর এলাকায় কোন স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করা হয়নি।’
একই কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব বলেন, হালিশহর ও পতেঙ্গা ছাড়াও নদীর ওপার থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসে। দুটি বিষয়ে অনার্স ক্লাস চালু থাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারি কলেজ না থাকায় এখানকার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সরকারি কলেজে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
৩৮নং দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশনের আহমদিয়া গালর্স স্কুল হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান ভরসা। বন্দর, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী পরিচালিত স্কুল ও কলেজ থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ কম। এছাড়াও ওইসব স্কুলে পাঠদান করা ব্যয়বহুলও। তাই বাধ্য হয়ে এখান অনেক শিক্ষার্থী নগরীর বিভিন্ন সরকারি স্কুল পাঠদান করতে হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট