চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাফল্যের সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজতেন না ইউসুফ চৌধুরী

মোহাম্মদ আলী

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১:১৪ অপরাহ্ণ

একজন কর্মবীর মানুষের প্রতিচ্ছবি মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। সদা বাস্তববাদী মানুষটি তাঁর ৮৬ বছরের জীবদ্দশায় অধিকাংশ সময় দেশ, মাটি ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। জীবনের শেষ বেলায়ও তিনি লাঠিতে ভর করে বঞ্চিত নগরবাসীর দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শহরের অলিগলিতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে সভা-সমাবেশ করেছেন। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সমস্যা সমাধান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নগরীর নালা-নর্দমা সংস্কার, পুনঃখাল খনন, যোগাযোগের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিআইটিকে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) রূপান্তর, হালদা রক্ষাসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

দৈনিক পূর্বকোণের রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর অধিকাংশ কর্মকা- আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর একটি কাজ আমাকে বেশ অভিভূত করতো। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি ধীরে-সুস্থে ভেবে নিতেন এবং পরে নিজের অভিমত প্রদান করতেন। উৎপাদনমুখী বিশেষ করে কৃষির প্রতি তাঁর বরাবরই দুর্বলতা ছিল। তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই কৃষি উৎপাদনের উপর জোর দিয়ে বক্তব্য রাখতেন। মানুষকে কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতেন।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া প্রসঙ্গে একদিন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম আপনি শহরে বসবাস করেন, অথচ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উৎপাদনমুখী কৃষির উপর এত বক্তব্য রাখেন কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পেঁয়াজ আমরা ১০/১৫ টাকা (তখন পেঁয়াজের দাম কম ছিল) কেজি দরে ক্রয় করি। সেদেশের চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য এদেশে আমদানি হয়। ভারতের পণ্য ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারি না। ক্রমাগত আমরা ভারত-নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা আমাদের জন্য ভাল লক্ষণ নয়। ভারতের কৃষকরা এত কম দামে এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে আর্থিকভাবে পোষাতে পারলে আমরা কেন পারি না। এদেশের মানুষ কম পরিশ্রমে অধিক সাফল্য চায়। এ ধরনের মন-মানসিকতা আমাদের ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে। তাই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব ঘোচাতে সর্বপ্রথম দরকার কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পতিত জমিতে ব্যাপকহারে চাষাবাদ করা।

আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য অপরিকল্পিতভাবে ফসলি জমি ব্যবহারের বিরুদ্ধেও তিনি সর্বদা সরব ছিলেন।  মফস্বলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে খালি জমি পড়ে থাকতে দেখে তিনি আমাকে বলতেন, সরকারের টনক নড়ে মতো এসব নিয়ে লেখালেখি করতে।

ইউসুফ চৌধুরী ধনীর ঘরের দুলাল ছিলেন না। নিরলস পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে তিনি একেবারে শূন্য থেকে আজকের এ পর্যায়ে উঠে এসেছিলেন। তিনি একের পর এক সম্পদ গড়ার কাজে বিশ্বাসী ছিলেন না, সমাজের গণমানুষের কল্যাণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে অবদান রাখতে পারে, সেদিকে তিনি বরাবরই সজাগ ছিলেন। সমাজে বেকারত্ব লাঘবে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোতে শতশত মানুষ চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সাফল্যের সংক্ষিপ্ত কোন পথের বিশ্বাসী ছিলেন না ইউসুফ চৌধুরী। তাই তিনি জীবদ্দশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এমনকি আমাদেরও তিনি পরিশ্রমে উৎসাহ যোগাতেন। তিনি একটি কথা আমাদের সবসময় বলতেন, পরিশ্রম কর সাফল্য ধরা দেবেই।

সময়ের প্রতি তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। কাউকে কোন কথা দিলে তা পালনে সচেষ্ট থাকতেন। তাঁর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি তা উপলব্ধি করতাম। সময়ের প্রতি সজাগ থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাথে গিয়ে আমাকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সাল কিংবা তারিখটা এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। খুব সম্ভবত ২০০৩ বা ২০০৪ সালের দিকে হবে। ইউসুফ চৌধুরী রাউজান উপজেলার সদর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। দৈনিক পূর্বকোণ থেকে এ সভার নিউজ কাভার করার জন্য আমার উপর দায়িত্ব পড়ে। অনুষ্ঠানের সময় ছিল বিকেল ৩টা। কিন্তু ইউসুফ চৌধুরী আমাদের নিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হন সোয়া তিনটায়।

অথচ অনুষ্ঠানে এ সময় আয়োজকদের মাত্র দুই-তিনজন উপস্থিত ছিলেন। অন্যরা ছিলেন বাড়িতে। বাঙালি সময় বলে কথা! অনেকে ধরে নিয়েছিলেন প্রধান অতিথি আসবেন বিকেল ৪-৫টার দিকে। কিন্তু ইউসুফ চৌধুরীর যথাসময়ে উপস্থিতি দেখে আয়োজকদের অনেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। দেরি না করে আমিও আয়োজকদের সাথে যোগ দিলাম। কীভাবে দ্রুত অনুষ্ঠান শুরু করা যায়, তা নিয়ে মনোনিবেশ করলাম। প্রধান অতিথির আগমনে মাইকে ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে আশপাশের বাড়ির লোকজন অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পরে বিকেল ৪টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়।

চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হওয়ায় এ ধরনের অনেক কিছু আমি দেখেছি। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার কারণে মাঝে মাঝে তাঁকে আমি অনুষ্ঠানে একটু দেরিতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতাম। কিন্তু কোন কাজ হতো না। তিনি সময়ের প্রতি ছিলেন একনিষ্ঠ। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি তা ধরে রেখেছিলেন।

লেখক: সাংবাদিক

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট