চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইউসুফ চৌধুরী স্বপ্ন থেকে প্রতিষ্ঠান

আবুল মোমেন

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ৩:০১ অপরাহ্ণ

তাঁর জন্মশতবর্ষে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে একবার তাকাতে ইচ্ছে করছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের কথা। একসময় পত্রিকার সাথে যোগ করলেন বইয়ের ব্যবসা। ইউসুফ চৌধুরী লেখাপড়া আর লেখাপড়া জানা মানুষের কদর বুঝতেন। গ্রামের সাধারণ পরিশ্রমী মানুষটা নিজেও একটা কসমোপলিটন মন অর্জন করলেন এই ব্যবসায় থাকতে থাকতে।

একটু পুঁজি জমতেই বসালেন নিজের প্রেস। সিগনেট প্রেস থেকে দোলনা নামে একটি ডাইজেস্ট পত্রিকা প্রকাশ শুরু করলেন ষাটের দশকে। আর প্রকাশ করলেন কিছু বই। সেই থেকে ইউসুফ চৌধুরীর যাত্রা শুরু হলো প্রকাশক হিসেবে।

১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আমরা কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে দ্য ডেইলি লাইফ থেকে পদত্যাগ করি। হঠাৎ বেকার হয়ে পড়ায় আমরা নতুন একটি কাগজ করার কথা ভাবতে থাকি। প্রথমেই আমার মনে আসে ইউসুফ চৌধুরীর কথা। তাঁর কাছে চলে আসি। ওয়াহিদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তবে ইউসুফ চৌধুরী আবেগে ভেসে যাওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না। খুবই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ। ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল খুবই পাকা। এতে আমাদের যেরকম রাতারাতি একটা কিছু করে ফেলার ইচ্ছা ছিল, তিনি সে পথে গেলেন না। তবে পত্রিকা প্রকাশের আগ্রহ বুঝতে দিলেন এবং আমাদের নিয়েই কাজটা করবেন, এমনটাই মনে হলো। সময় নেওয়ার আরও কারণ, তখনকার সামরিক শাসনে পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়া ছিল অনিশ্চিত। প্রাথমিকভাবে ওয়াহিদ ভাইকে উনি মাসিক একটা বেতন চালিয়ে যেতে রাজি হলেন। আর আমাকে প্রস্তাব দিলেন দোলনা প্রকাশনীতে যোগ দিয়ে আপাতত সেটিকে চাঙ্গা করতে। সেভাবে আমরা কাজে যুক্ত হলাম।

১৯৮৪-র দিকে পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা ভালোভাবে শুরু হয়। এ সময়ে আমার সাথে যুক্ত হয় অনুজ সাংবাদিক-বন্ধু মোহাম্মদ বেলাল (প্রয়াত) আর উৎসাহী কবি ও নাট্যজন শিশির দত্ত। নিজের তিন ছেলেকেই ইউসুফ চৌধুরী পেশাদারী শিক্ষায় উচ্চতর লেখাপড়া করিয়েছেন। বড়জন তসলিম উদ্দিন চৌধুরী (পরবর্তীকালে পূর্বকোণের সম্পাদক ও বর্তমানে প্রয়াত), মেজ জসিম (পূর্বকোণের প্রকাশক ও পরিচালনা সম্পাদক জসিম উদ্দিন চৌধুরী) ব্যবসায় প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশুনা করে প্রেসেই বসত আর ছোট রমিজের (এখন পূর্বকোণের সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী) তখনও ডাক্তারি পড়া শেষ হয়নি। তবে তার খুবই আগ্রহ দেখেছি প্রকাশনা ও ফটোগ্রাফিতে। নানা বিষয়ে মতামত চাইতো, আবদার করতো আমার কাছে।
অবশেষে ১৯৮৫-তে ডিক্লারেশনের তোড়জোড় ভালোভাবে শুরু হলো। আমি ও জসিম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক শ্রদ্ধাভাজন ড. আনিসুজ্জামানের কাছে পত্রিকার নামের জন্য গেলাম। নানা বিকল্পের মধ্যে ‘পূর্বকোণ’ নামটাই সাব্যস্ত হলো। আজ পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে একথা হয়ত বলা যায়, পত্রিকা প্রকাশে ইউসুফ সাহেবের ডান হাত হিসেবে কাজ করেছি আমি। পুরো পরিকল্পনা, লোক নির্বাচন, নিয়োগ সবই আমার পরামর্শে হয়েছে। এ ব্যাপারে একপ্রকার স্বাধীনতাই তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।

ইউসুফ চৌধুরী নিশ্চিত করেছিলেন মুদ্রণ সৌকর্য ও পারিপাট্যের। আর আমি চেয়েছি নতুন সময়ের আধুনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে। তাই সাধ্যমত নতুনদের জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

মালিকপক্ষ ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে সেতু ছিলাম আমি। পরে শিশির, বেলালরাও প্রকাশকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একসাথে বেলাল-শিশির-তসলিম-বাচ্চু (রমিজ) নানা জায়গায় গেছে। রাতের বেলা পোস্টার লাগানোর কাজে হয়ত গাড়িতে সঙ্গ দিয়েছে বাচ্চু।

আমি ১৯৯৫ সনে পূর্বকোণ ছেড়ে দেই। তারপর ছাব্বিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। আমাদের আমলের বেশিরভাগ সংবাদকর্মী আর পূর্বকোণে নেই। অনেকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেছেন, আর কেউ কেউ অন্য কাগজে চলে গেছেন। এই দীর্ঘ ৩৫ বছরে নানা ঝড়ঝঞ্ঝা কাটিয়ে পূর্বকোণ টিকে আছে, এটাই বড় কথা। এর মধ্যে এর প্রাণপুরুষ ইউসুফ চৌধুরী ২০০৭ সনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। এর পরে চৌদ্দ বছর ধরে তাঁকে ছাড়াই পত্রিকা চলছে এবং এগিয়েই চলছে। আর ইতিমধ্যে ইউসুফ সাহেব পূর্বকোণ এবং ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূত্রে নিজের প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে বৃহত্তর সামাজিক স্তরে একটা জায়গা করে নিয়েছেন। সবটা মিলিয়ে শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করা জরুরি। তিনি চট্টগ্রামে একটি আধুনিক রুচিশীল সংবাদপত্র প্রকাশে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট