চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী

ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ২:২৯ অপরাহ্ণ

১৯ সেপ্টেম্বর ইউসুফ চৌধুরীর একশতম জন্মবর্ষ পূরণ হলো। সশরীরে তিনি আমাদের মাঝে নেই এক দশকেরও অধিক সময় ধরে। কিন্তু আমার কাছে তিনি আজও বর্তমান। তিনি আমাদের প্রিয়জন; জীবিত থেকে মৃত্যু অবধি তিনি আমাদের যা দিয়েছেন, আজ তা-ই স্মরণ করার দিন। ‘সব আলোটি কেমন করে ফেলো আমার মুখের কাছে? তুমি আপনি থাকো আলোর পেছনে’ কবিগুরুর সেই কবিতা আমাকে তাই মনে করিয়ে দেয়। ইউসুফ চৌধুরীর মুখ্য পরিচয় সফল উদ্যোক্তা। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে সকল প্রতিকূলতা উৎরিয়ে কীভাবে সফল ও বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হওয়া যায়, তাঁর জীবনের সে গল্প নতুন প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে সন্দেহ নেই। এই গল্প নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ বিস্তৃত লিখবেন। আমি জানাবো একজন উদ্যোক্তা কীভাবে শিক্ষা বিস্তারেও সফল হলেন, তারই একটি দৃষ্টান্ত।

ব্যবসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা। তার মধ্যে আধুনিক দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠায় তিনি চট্টগ্রামের পথিকৃৎ। তিনি শুধু খামার প্রতিষ্ঠা করেননি, অন্যদেরও খামার প্রতিষ্ঠা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদেরকে নিয়ে সফল দুগ্ধখামারি হওয়ার জন্য দুগ্ধখামারি সমিতি গড়েছেন এবং তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে একটি দুগ্ধখামারি আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছেন। এ বিষয়টির অবতারণা এ কারণে, তৎসময়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ আল নোমানের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের দুগ্ধখামারিদের সাথে নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত করে খামার সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি শুধু খামারের সমস্যা সমাধানেই ক্ষান্ত হননি- এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি মেতে উঠেন এবং তা হলো, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার এক সফল সামাজিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন।

চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীতে অবস্থিত সরকারি মুরগির খামারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রথম দিন থেকে নিরবচ্ছিন্ন প্রায় দেড় দশক কর্মরত থাকা অবস্থায় ইউসুফ চৌধুরীর সাথে আমার নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্ক পরবর্তীতে ভেটেরিনারি চিকিৎসায় সারাদেশে প্রথম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এক মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে রূপান্তরিত হয়।

কলেজের শিক্ষক এবং উপাধ্যক্ষ হিসেবে আমি যোগদান করি ১৯৯৬ সনের নভেম্বর মাসে এবং ইউসুফ চৌধুরীর সাথে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ-পরিচয়, মতবিনিময় শুরু হয় ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে দুগ্ধখামারির এক আনুষ্ঠানিক সভায়। উনার প্রথম প্রশ্ন, ভেটেরিনারি কলেজ আমাদের খামারিদের জন্য কী করবে?

এই সহজ প্রশ্ন নানারূপে-নানাভাবে তিনি আমাকে করে গেছেন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি যা যা বলেছি তা এখানে বর্ণনা সম্ভব নয়। তবে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ভেটেরিনারি কলেজ চট্টগ্রামবাসীর কাছে দৃশ্যমান হলো, ক্রমান্বয়ে দেশে পরিচিতি লাভ করলো এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লেও পরিচিতি লাভ করতে শুরু করলো। এ প্রতিষ্ঠান শুরুতেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলো: কলেজের জন্য বরাদ্দকৃত জমি প্রদান করা হচ্ছে না, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিলম্ব, শিক্ষা সুযোগের অপ্রতুলতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথমদিকে কিছুদিন পরপর, তারপর প্রায় প্রতিদিন। তাঁর আরেক সহযোগী শাহেদুল আলম কাদরী তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন।

এক সময়ে বরাদ্দকৃত জমি পাওয়া গেল। ভৌত অবকাঠামোও গড়ে উঠল। শিক্ষা কার্যক্রমের গতিশীলতা, উৎকর্ষ সাধনের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মহলে স্বীকৃতি পেতে শুরু করলো। প্রতিষ্ঠানের এই প্রসারের প্রচার কাজে তিনি পূর্বকোণকে মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এমনি করে আলোচনার এক পর্যায়ে উঠে এল এ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা যায় কিনা। কেউ কেউ এ প্রস্তাবে আঁতকে উঠলেন। দশ বছরই যার বয়স হয়নি, এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা, তাও কি সম্ভব? মানুষের এমন প্রশ্নের উত্তরের জন্য তিনি আমাদের শরণাপন্ন হয়েছেন কতবার, তা বলে শেষ করা যাবে না।

এমন প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে যুক্ত করলেন এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলনে। সমাজের গুণীজন, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, খামারি ও সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন ছড়িয়ে দিলেন এবং তিনি হয়ে উঠলেন এ আন্দোলনের মুখপাত্র।

২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের সকল স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় তাঁরই নেতৃত্বে গঠিত চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে একযোগে প্রকাশিত হলো এক ক্রোড়পত্র। প্রকাশ করা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা। সকল প্রশ্নের সমাধান করে এ দাবি ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের মানুষের গণদাবিতে পরিণত হলো এবং তার অগ্রভাগে ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। একদিন সে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলক উন্মোচিত হলো এবং ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে সকল আইনি পথপরিক্রমা শেষে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হলো এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় তার কার্যক্রম শুরু করলো। একটি সামাজিক আন্দোলনের এমন সফল পরিণতি আমরা সকলে প্রত্যক্ষ করলাম।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর শারীরিক উপস্থিতি নেই, কিন্তু তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে, সমগ্র বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরেও স্বমহিমায় প্রতিনিয়ত উজ্জ্বলতর হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যা চর্চার অঙ্গীকার নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দেড় দশকের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, দেশ ও জাতির স্বার্থেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন ছিল। ইউসুফ চৌধুরী এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগে ছিলেন। তাঁর প্রধান পরিচয় উদ্যোক্তা; কিন্তু উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ সৃষ্টিশীল ও ব্যতিক্রমী। বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দুগ্ধখামার প্রতিষ্ঠা ছিলো তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষ মানবসম্পদ ব্যতীত এ ধরনের ব্যবসায়ী উদ্যোগ সফল হবে না। আমরা উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবো না। তাঁর এ অনুভূতির কারণেই জীবনের শেষভাগে ক্লান্তিহীন রূপে ওই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এই সামাজিক অঙ্গীকার সদা তাঁকে কর্মব্যস্ত রেখেছে। সকলকে একত্রিত করে পথ চলতে চেয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। তাঁর একশততম জন্মবর্ষপূর্তির দিনে তাঁকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।

ইউসুফ চৌধুরীর একশততম জন্মবর্ষপূর্তি পারিবারিক নয়, দেশ-সমাজ সকলের। গ্রিক প্রবাদের মতোই ‘তাঁর জন্মদিন, জন্মবর্ষ আমাদেরও। এসো হে স্বজন, এসো হে মানুষ। তিনি আমাদের, তিনি আমাদের। স্মরণ করি তাঁকে। তাঁর জন্মদিনেই আমাদের প্রেরণা।’

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)

পূর্বকোণ/ফিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট