চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরীর দুর্দম্য প্ররোহ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১:৫৫ অপরাহ্ণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার এ জন্মদিন’ কবিতার পংক্তি উচ্চারণে চট্টলদরদী কৃতিমানব ক্ষণজন্মার জীবনচরিত প্রয়াত ইউসুফ চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা নিবেদন করছি। ‘আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা/আমি চাহি বন্ধুজন যারা/ তাহাদের হাতের পরশে/ মর্ত্যরে অন্তিম প্রীতিরসে? নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,/ নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।/ শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;/ দিয়েছি উজাড় করি যাহা-কিছু আছিল দিবার,/ প্রতিদানে যদি কিছু পাই/ কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই/ পারের খেয়ায় যাব যবে/ ভাষাহীন শেষের উৎসবে।’ উল্লেখ্য চরণসমূহ পরমশ্রদ্ধেয় ইউসুফ চৌধুরীর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিমানস নির্মাণে কতটুকু প্রাসঙ্গিক-প্রযোজ্য; তা সহজেই অনুমেয়-অনুধাবনযোগ্য। সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে নিজেকে উন্নীত করার এক জ্ঞানস্ফীত পাঠশালা সর্বজনশ্রদ্ধেয় দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। ত্রৈকালিক অভিযাত্রায় প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহের সমন্বয় ঘটিয়ে রচনা করেছেন জীবন-দর্শনের তৌর্যত্রিক পান্ডুলিপি। উপমহাদেশের ইতিহাসে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-সুশীল ও সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করার মোহময় শক্তিময়তায় ঋদ্ধ ইউসুফ চাচা পূর্ণাঙ্গ সার্থক হয়েছিলেন স্বকীয় সত্ত্বার নিগূঢ় অবগাহনে। অনুপম অনুপ্রেরণা ও তেজোদীপ্ত মহিমায় আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মসংযমী-আত্মত্যাগী হওয়ার অপার সম্ভাবনার দ্বার-উম্মোচক সকলের সর্বাধিক প্রিয় চাচা ইউসুফ চৌধুরী।

খ্যাতিশীর্ষ দেশ ও বিশ্বের মহামানবদের পরিপূর্ণ অনুসরণে প্রয়াত ইউসুফ চৌধুরী নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন এক অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠানে। দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞের প্রতিস্থাপন তাঁকে প্রতিদিনই চট্টগ্রামবাসীর প্রাণস্পন্দনে অত্যুজ্জ্বল করে তোলে। বিশ্বে যাঁরা অতুলনীয় বিস্ময়কর অবস্থানে মর্যাদাসীন হয়েছেন; ধারাবাহিকতায় মাটি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ব-দায়িত্ববোধ জন্ম-জন্মান্তরে সময়-কালের পরিক্রমায় নতুন ধারার ¯্রষ্টা হিসেবে বাংলাদেশে প্রয়াত ইউসুফ চৌধুরী উঁচুমার্গে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। পরম শ্রদ্ধেয় ইউসুফ চাচার সফল ও সার্থক স্মারক হচ্ছে; বিবেক-আবেগ-দেশপ্রেমের চন্দ্রাতপ আচ্ছাদনে অকৃত্রিম নিষ্ঠা-মেধা-শ্রমের পরিচর্যায় নিজের আবক্ষ অপরূপ শৈলীতে নিজেই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। উঁচুমাত্রিকতায় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের প্রণিধি অভিভাবক ও অফুরন্ত উদ্ভাবনী দীপনে প্রয়াত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর দীপ্যমান প্রকাশ গৌরবদীপ্ত মহিমায় শুধু চট্টগ্রাম নয়; পুরো বাঙালি জাতিরাষ্ট্রকে করেছে পরিলক্ষিত আলোকোজ্জ্বল। গণমাধ্যম্যের গুণগত উৎকর্ষতা, বস্তু-সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা, সাহিত্য-শিল্পকলা, ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির সার্বিক বিষয়ে সমসাময়িক পদচারণায় আকর্ষণীয় আঙ্গিক ও কলবরে ব্যাপৃত দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিল্পপতি, মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, অসাম্প্রদায়িক মানবিক ও দেশপ্রেমিক ইউসুফ চাচার জীবনের আড়ালে বহু ঘটনা এখনোও অনাবিষ্কৃত।

১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টম্বর চট্টগ্রামের বিখ্যাত রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়া নামক অজপাড়াগাঁয়ে পিতা আলহাজ দুলামিয়া এবং মাতা আজিজা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয়া এই মহান ব্যক্তিটি অবিচল নিষ্ঠা-অক্লান্ত পরিশ্রম-সময়ানুবর্তিতা ও নিবিড় অধ্যাবসায়ের বীজাঙ্কুর চেতনায় নিজের অবস্থানকে জ্যোতির্ময় আলোবর্তিকায় সমাসীন করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে উচ্চ-মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত প্রয়াত ইউসুফ চাচা জীবনে প্রথম কর্মবীর হতে পেরেছেন রাউজানের ফকিরহাটে ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি’র মাধ্যমে বইয়ের ব্যবসা শুরু করে। সেই ব্যবসায় সফল না হয়ে চট্টগ্রাম নগরের জুবলী রোডে ‘অরিয়েন্ট স্টোর’ নামে ষ্টেশনারি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। সমবায় সমিতি ভবনের পাশে এই দোকান তাঁর জীবনে মোড় ঘুরানোর মাইলফলক স্বরূপ রাজসিক স্থাপনা।

১৯৪৯ সালের শেষ পর্যায়ে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান’র এজেন্সি গ্রহণ এবং সংবাদপত্র ও বই বিপণন ব্যবসায় মনোযোগী হন। পরবর্তীতে তিনি ‘নিউজ উইক’-‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ – ‘উইকলি টাইম্স’ -‘দ্য ডেইলি ডন’ পত্রিকাসমূহের এজেন্সি প্রাপ্ত হন।

‘নিউজফ্রন্ট’ নামক পুস্তক প্রতিষ্ঠান, ১৯৬১ সালে প্যাকেজিং শিল্পের উদ্যোগ, ১৯৮৪ সালে সিগনেটবক্স স্থাপনের আরাধ্য অভিজ্ঞতায় ১৯৮৬ সালে আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশনা ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের বিজয়বাহন। অত্যধিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়; তিনি ‘নিউজফ্রন্ট’ থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘জীবন নির্ভর’ নাটক এবং অধ্যাপক আবুল ফজলের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ বই প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম তথা দেশের কৃষি-সংস্কৃতি সৃজনে তাঁর কার্যকর অবদান সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য। ১৯৯২ সাল থেকে ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্প আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে চট্টগ্রামের প্রায় চারশত খামার এবং প্রথম গবাদি পশুর মেলার প্রধান উদ্যোক্তা খ্যাতিতে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। ডেইরি শিল্পের বিকাশে চট্টগ্রামে প্রথম তাঁর নেতৃত্বে রুগ্ন গরু নিয়ে মিছিল করা হয়। তিনি ছিলেন ডেইরি ও পোলট্রি ফার্ম এসোসিয়েশনের আমৃত্যু সভাপতি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউনাইটেড ক্যামিকেলস’ নামক প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ঔষধশিল্পে এখনও অকল্পনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে।

কবি নজরুলের আগমনস্থল নিজ বাড়িতে নজরুল মেলার আয়োজন ও নজরুল পাঠাগার স্থাপন করে নজরুল স্মৃতি রক্ষার জন্য কর্মযোগী মানুষ হিসেবে পরিখ্যাত অধ্যায় নির্মাণ করেছেন। চট্টগ্রামের বিআইটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর নিরলস জোরালো ভূমিকা পালনের জন্য ‘চট্টলদরদী’ উপাধিতে ভূষিত হন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রামবাসীর সার্বিক দুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, পানি সঙ্কটসহ নানা সমস্যা চিহ্নিতকরণে তিনি ছিলেন অগ্রগন্য। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ, হালদা নদীতে মৎস প্রজননের উপযোগী সংস্কার এবং উন্নয়ন, কর্ণফুলী নদীকে দখল-পরিবেশ দূষণ মুক্ত করে পরিকল্পিত নগরী প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে জনগণকে সচেতন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং যুগোপযোগী কর্মকৌশল আধুনিকায়নে উচ্চকিত কন্ঠস্বর ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি হালদা নদী নিয়ে দৈনিক পূর্বকোণে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২০০২ সালে হালদা নদীর সোনাইচর বাঁক কাটার প্রেক্ষিতে হালদার পরিবেশ রক্ষায় পূর্বকোণ পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন প্রয়াত ইউসুফ চৌধুরী।

শ্রদ্ধেয় ইউসুফ চৌধুরীর আদর্শকে ধারণ করে চট্টগ্রামের জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে দৃশ্যমান সঙ্কটগুলোকে সুস্পষ্টভাবে জনসম্মুখে প্রতিস্থাপন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে দৈনিক পূর্বকোণের অনবদ্য ভূমিকা ও এর গ্রহণযোগ্যতা চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে দীপ্যমাণ হতে সহায়ক হয়েছে। সমস্যার স্বরূপ উম্মোচন ও সমাধানের কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণে দৈনিক পূর্বকোণের লেখনি-প্রতিবেদন যুগান্তকারী অবদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। করোনা প্রতিরোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে জনমত গঠন ও সচেতনতা সৃষ্টিতে দৈনিক পূর্বকোণের অবিরাম প্রচারণা সর্বত্রই সমাদৃত। প্রয়াত ইউসুফ চৌধুরীর অমর কর্মের অপরূপ দৃষ্টান্ত হিসেবে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ গণমাধ্যম জনপ্রিয়তায় আঞ্চলিক সংবাদপত্রে অনন্য অবদানের জন্য দেশসেরা আঞ্চলিক পত্রিকার মর্যাদার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক ও আঞ্চলিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা ২০২১ প্রাপ্ত হয় দৈনিক পূর্বকোণ। এই অভূতপূর্ব স্বীকৃতি শ্রদ্ধেয় ইউসুফ চাচার জন্মশত বার্ষিকীর শুভলগ্নকে করেছে অধিকতর মহিমান্বিত। চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরীকে নিরন্তর স্মরণযোগ্য করার লক্ষ্যে এই অর্জন চিরঅম্লান-চিরঅক্ষয় অভিধায় অভিষিক্ত হল। আবারও তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। বর্তমান প্রকাশক-সম্পাদক-সাংবাদিক-লেখক-সকল কলাকুশলীদের জানাই অফুরন্ত শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট