চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাতৃসদনকে জে. হাসপাতালে রূপান্তরের পরিকল্পনা # বন্দর ও নেভী হাসপাতালে সাধারণের চিকিৎসাসেবা নেই

হাসপাতালবঞ্চিত ১৯ লাখ মানুষ

পতেঙ্গা-হালিশহরবাসীর সুখ-দুঃখ : ৪

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও আল-আমিন সিকদার

১০ জুলাই, ২০১৯ | ২:১৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মহানগরীর বৃহত্তর পতেঙ্গা ও হালিশহরের পাঁচটি ওয়ার্ডে ১৯ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা রয়েছে এই এলাকায়। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এখানকার বাসিন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে একটি হাসপাতালের দাবি করে আসছে এই জনপদের মানুষেরা। যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও উপেক্ষিত সেই গণদাবি। চার ওয়ার্ড কাউন্সিলর একবাক্যে বলেন, ‘এখানকার মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ছিটেফোঁটাও পায় না তারা।’
৩৮নং দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী ও ৩৯নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘এখানকার বাসিন্দারা মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানির অনেক কষ্টে রয়েছে।’ কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘হোমিওপ্যাথিক ও বিভিন্ন ফার্মেসিতে প্রাইভেট চিকিৎসকদের উপর নির্ভর করে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। জরুরি অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং বেসরকারি ক্লিনিক ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে যানজট। জরুরি কোন রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় যানজটে আটকা পড়ে পথেই রোগীর মারা যাওয়ার অবস্থা।’
বৃহত্তর এই জনপদের ৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯নং হালিশহর ওয়ার্ডে একটি মাতৃসদন হাসপাতাল রয়েছে। এখানে গর্ভবতী মা ও শিশুর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসক, নার্স, আয়া ও কর্মচারী সংকটে পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া যায় না বলে জানান স্থানীয়রা।
কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন মাতৃসদন হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মানের বিষয়ে বলেন, ‘চিকিৎসক ও কর্মচারী সংকটের কারণে আমরা পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছি না।’ তবে বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার কথা চিন্তা করে এটিকে একটি পরিপূর্ণ হাসপাতালে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। মেয়র সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাইকার মাধ্যমে এটিকে জেনারেল হাসপাতালে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ ওয়ার্ডের মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন বন্দর হাসপাতাল ও নৌবাহিনীর নেভী হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ পান। এখানে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে হলি কেয়ার নামে বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। তাও অপর্যাপ্ত। সীমাবদ্ধতার কারণে জরুরি ও গুরত্বপূর্ণ সেবা এখানে পাওয়া যায় না বলে জানায় এলাকাবাসী।



নগরীর শেষপ্রান্তে উত্তর-মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গায় ১৯ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা হয়েও নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এখানকার বাসিন্দারা। ভোগান্তির কমতি নেই। নগর উন্নয়নে যত উন্নয়নমূলক কর্মকা- চলছে তার বেশিরভাগই হচ্ছে এ এলাকাজুড়ে। নির্মাণ করা হচ্ছে রিং রোড, বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় অনেক প্রকল্প। এই জনপদকে ঘিরে এতোসব উন্নয়নের ভিড়ে একটি মৌলিক চাহিদার অভাবে দিনের পর দিন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এ অঞ্চলের বাসিন্দা। একটি হাসপাতালের দাবি দীর্ঘদিনের।
দক্ষিণ হালিশহর এলাকা থেকে দক্ষিণ পতেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ লোকের বসবাস। এই অঞ্চলে রয়েছে দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল। যেখানে তিন লাখেরও অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তাদের বেশির ভাগ লোকের বাসস্থান এই অঞ্চলে। বৃহত্তর হালিশহর হচ্ছে নগরীর ঘনবসতি এলাকা। শুধু দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ও দক্ষিণ হালিশহর দুটি ওয়ার্ডে রয়েছে সাড়ে ১১ লক্ষাধিক মানুষ। অন্য তিনটি ওয়ার্ডে রয়েছে সোয়া আট লাখ। সবমিলে পাঁচটি ওয়ার্ডে রয়েছে ১৯ লক্ষাধিক মানুষ। এই জনসংখ্যার বাইরে ইপিজেড ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লক্ষাধিক মানুষ রয়েছে। কিন্তু বিশাল এই জনগোষ্ঠীর নেই কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা।
হালিশহর এলাকার মো. শাকিল নামের এক যুবক বলেন, এই অঞ্চলে আট লক্ষাধিক মানুষের বসবাস হলেও চিকিৎসাসেবা নেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। কারণ এখানে নেই কোন সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল। অন্যদিকে নগরীর হাসপাতালপাড়া খ্যাত চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, মেহেদীবাগ ও জিইসি এলাকায় একটি সরকারি হাসপাতালকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল। এরমধ্যে উন্নতমানের বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে। অথচ তার বিপরীত চিত্র পতেঙ্গা-হালিশহর অঞ্চলের। সরকারি-বেসরকারি কোন হাসপাতাল না থাকায় চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত বৃহৎ জনগোষ্ঠী।
মিজানুর রহমান নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এ পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। তার উপর রয়েছে বন্দর, ইপিজেড ও কাস্টমস মোড়ে মালবাহী গাড়ির তীব্র যানজট যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। এ কারণে চমেক হাসপাতালে পৌঁছতে রোগীকে অনেকসময় পথেই প্রাণ হারাতে হয়। অথচ চিকিৎসাসেবা আমাদের মৌলিক চাহিদা। এ এলাকায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।



৪০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন বলেন, এ অঞ্চলে একাধিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে একটি হাসপাতালের অভাবে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। স্টিলমিল বাজারের বার্মা কলোনির পাশে হোসেন আহম্মদ পাড়ার জামে মসজিদ এলাকায় এক একরের সরকারি খালি জায়গা রয়েছে। যেখানে একটি হাসপাতাল তৈরির জন্য প্রস্তাবনা করেছিলাম। তবে বিষয়ে এখনো মন্ত্রণালয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
৩৭নং উত্তর-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শফিউল আলম বলেন, বন্দর হাসপাতাল থাকলেও সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ পায় না। হালিশহর এলাকায় অনেক সরকারি জায়গা রয়েছে। অনেক বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। এখানে একটি সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ এখন সময়ের দাবি, মানুষের প্রাণের দাবি। কারণ কোনো হাসপাতাল না থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যার দূরত্ব অনেক বেশি। তাছাড়াও রয়েছে যানজট। কয়েক লাখ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে এই অঞ্চলে একটি হাসপাতাল নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট