চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বায়েজিদে পাহাড় কাটার মহোৎসব

নাজিম মুহাম্মদ 

৩ আগস্ট, ২০২১ | ১২:৪২ অপরাহ্ণ

বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় কেটে কেউ তৈরি করেছে মসজিদ, আবার কেউ এতিমখানা। পাহাড় দখলে পিছিয়ে নেয় পুলিশও। এ যেন পাহাড় কাটার মহোৎসব।

বায়েজিদ থানার চন্দ্রনগর, চৌধুরী নগর, শেরশাহ বাংলা বাজার, আকবরশাহ শাপলা আবাসিক এলাকাসহ অন্তত ২০টি স্থানে চলছে পাহাড়কাটা। গতকাল সোমবার পরিবেশ অধিদপ্তর সরেজমিন ঘটনাস্থলে গেলে দেখা যায় পাহাড় কাটার ভয়াবহ চিত্র। পাহাড় কাটার অপরাধে ১০ জনকে নোটিশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

নগরীর টেক্সটাইল মোড় থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই চন্দ্রনগর। তার পাশেই চৌধুরী নগর। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সেখানে চলছে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটা। স্থানীয় লোকজন জানান, পাহাড়ী জমি দখল, পাহাড় কাটা ও প্লট বাণিজ্যে সেখানে রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। যেমন- চৌধুরী নগরে জনৈক বাদল, বাহার উদ্দিন, বাদলের ছোটভাই লিটন ও বাবু পাহাড় কাটা ও প্লট বেচাকেনার সাথে জড়িত। চৌধুরী নগরের পাহাড়ের পাদদেশে সদ্য কাটা একটি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে হালিমা আক্তার। তার ঘরেই পাওয়া গেলো পাহাড় কাটার শাবল আর খুন্তি।

হালিমা জানান, তার স্বামী  হাশেম কেয়ার টেকার হিসাবে কাজ করে। পাহাড়া  কেটে জমি তৈরি করছে জনৈক ইব্রাহিম ও রুবেল। তারা অক্সিজেন এলাকায় থাকে। বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথেই সেখানে পাহাড় কাটা শুরু হয়। খুন্তি ও শাবল দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মাটি সরিয়ে রাখে তারা। বৃষ্টি পড়লে  পাহাড়ের কাটা অংশের উপরিভাগ ধসে পড়ে। হালিমার পাশেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করেন বকুলী। তিনি জানান, তারা তিন পরিবার সেখানে থাকেন। প্রতি রুমের জন্য মাসিক ২৫০০ টাকা ভাড়া দেন। ঘরের মূল মালিক মাস্টার শহীদ। তিনি সেখানে থাকেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আল-আমিন বলেন, নগরীর অন্য এলাকার চেয়ে বায়েজিদ এলাকার তাপমাত্রা অনেক বেশি। এলাকাটি এখন হিট আইল্যান্ডে (তাপ দ্বীপ) পরিণত হয়েছে। মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এলাকায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠার পর সেখাকার পাহাড়গুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। একই ধরনের পাহাড় রয়েছে বায়েজিদ এলাকায়। সেখানে কল কারখানা গড়ে উঠার পর এলাকাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। কলকারখানাগুলো যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে সে পরিমাণ কার্বন পুষিয়ে দেয়ার কথা। কলকারখানার আশেপাশে বন থাকা খুবই জরুরি কিন্তু কারখানার মালিকরা একটি গাছও রোপণ করেনি। বায়েজিদ খুলশীসহ আশেপাশের এলাকাগুলো শহরতলীতে হওয়ায় সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠছে। আর আবাস গড়ে তুলতে পাহাড় কাটা হচ্ছে।

আল-আমিন বলেন, সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ী অঞ্চলে প্রচুর বাড়িঘর রয়েছে। কিন্তু সেখানে পাহাড় কাটা হয়নি। আমাদের দেশেও চাইলে পাহাড় না কেটে বাড়িঘর তৈরি করা সম্ভব। সামান্য জমি বাড়াতে পাহাড় কাটা হচ্ছে।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী শামসুল হুদা। চৌধুরী নগরে তার নামে রীতিমতো একটি পাহাড় রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে হুদা পাহাড় নামে পরিচিত ওই পাহাড়ের পাদদেশে তিনি তৈরি করেছেন বিশাল কলোনি। নাম দেয়া হয়েছে হুদা কলোনি। হুদা কলোনিতে ৪০টি  ঘর রয়েছে। কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়া তিনি সেখানে স্থাপন করেছেন গভীর নলকূপ। পুরো এলাকায় অন্তত চারশো ঘরে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করেছেন হুদা। এ  যেন মিনি ওয়াসা।

প্রতিবেশী লোকজন জানান, আশেপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে পানির লাইন দিয়েছেন শামসুল হুদা। প্রতিদিন পনেরো মিনিট করে পানি সরবরাহ করেন তিনি। বিনিময়ে মাসিক বিল নেয়া হয় ৯ শ টাকা। হুদা কলোনির পাশে  পাকা ভবন তৈরি করেছেন সেলিম। তিনি নিজেকে নগর ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে বলেন, পাশে পাহাড় কাটার কারণে তার ঘরটি ঝুঁকিতে পড়েছে। শামসুল হুদার সাফাই গেয়ে সেলিম বলেন, হুদা সাহেব একজন সমাজসেবক। তিনি পুরো এলাকায় পানি দিয়ে সমাজ সেবা করছেন।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, শামসুল  হুদা বলেন, আমি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছি দেড় বছর আগে। আশেপাশের লোকজনের পানির সুবিধার্থে আমি লাইন দিয়েছি। দোষের হলে খুলে ফেলবো। গভীর নলকূপ স্থাপনে ওয়াসার অনুমোদন নিয়েছে কিনা প্রসঙ্গে হুদা বলেন, আমার মতো আরো অনেকে সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। কারো অনুমোদন নেই। ওয়াসা বলেছে আমাদেরকে পানির লাইন দেবে। তখন নলকূপের অনুমতিও  নিয়ে নেবো।

চৌধুরী নগর পার হয়ে পাহাড়ের চূড়া বেয়ে চন্দ্রনগর এলাকায় গেলে দেখা যায় পাহাড়া কাটার আরো ভয়াবহ চিত্র। সেখানে আস্ত পাহাড় কেটে চরম ঝুঁকিতে তৈরি করা হয়েছে একটি মসজিদ। নাম দেয়া হয়েছে মুহাম্মদীয়া জামে মসজিদ। কাটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে টিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মুহাম্মদিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এতিমখানার ভেতরে বেশকিছু শিশু-কিশোরও দেখা যায়। পাহাড়ধসে যেকোনো মুহূর্তে এতিমখানায় থাকা শিশু-কিশোরদের ভয়াবহ ট্র্যাজেডির শিকারের আশংকা রয়েছে। ইসমাইল হুজুর নামে এক ব্যক্তি মসজিদ ও মাদ্রাসার নামে পুরো পাহাড়টি কেটে দখল করেছেন বলে জানান স্থানীয় লোকজন। ওই মাদ্রাসা ও মসজিদের পাশে আরো একটি পাহাড় মাদ্রাসার সাইনবোর্ড বসিয়ে দখল করেছেন আতাউল্লাহ হায়দার নামে এক ব্যক্তি। অবৈধভাবে দখল করা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপুর্ণ ঘরগুলোতে দেয়া হয়েছে বিদ্যুতের মিটার। তবে পাহাড় কাটার পর বনায়ন বুঝাতে অবৈধ দখলদাররা রোপন কওে রেখেছে কলাগাছ।

চন্দ্রনগরে এখনো মাথা তুলে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে নাগিন পাহাড়। পাহাড়টি অর্ধেক অংশ ইতিমধ্যে কাটা শেষ হয়েছে। বাকিটাও নিশ্চিহ্ন হবার পথে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট