চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

দিশেহারা খুদে ব্যবসায়ীরা

মিজানুর রহমান 

৩১ জুলাই, ২০২১ | ১:১৩ অপরাহ্ণ

চার বছর আগে বন্ধু মোহাম্মদ আজিজের সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসায় নামেন সাতকানিয়ার আব্দুস সোবহান। টেরিবাজারে ভাড়ায় দোকান নিয়ে ভালোই ব্যবসা করছিলেন দুইজন। কিন্তু দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর এর বিস্তার ঠেকাতে একের পর এক লকডাউন ধস নামায় তাদের ব্যবসায়।

সরকারি বিধিনিষেধ মেনে দীর্ঘদিন দোকান বন্ধ রাখায় আয়ের পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেলেও খরচ কমেনি এতটুকু। কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, আয়কর, সেবা সংস্থাগুলোর বিল পরিশোধের মতো নিশ্চিত খরচ এখন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’। যার যোগান দিতেই দিশেহারা এই দুই খুদে ব্যবসায়ী।

টেক্সটাইল মোড়ের ভাত ঘরের মালিক মানিক মিয়ার অবস্থা আরো করুণ। লকডাউনের কারণে খাবারের ব্যবসা বন্ধ থাকায় কুমিল্লার এই যুবক সংসার চালাতে এখন ভ্যানে আম বিক্রি করছেন। এতে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চললেও ভাত ঘরটির ভাড়া বকেয়া হয়ে গেছে দুই মাসের।

কবে লকডাউন উঠবে, কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে, কবে ভাতের ব্যবসা শুরু করতে পারবেন- তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই মানিক মিয়ার। তার প্রশ্ন- সরকার সংক্রমণ কমাতে লকডাউন দিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে দোকান বন্ধ রেখেছি। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারবো?

শুধু আব্দুস সোবহান কিংবা মানিক মিয়া নন- দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় এই দুইজনের মতো খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ী রয়েছেন অন্তত সাড়ে ৩ লাখ। লকডাউনে সরকারি নির্দেশনা মেনে দোকান বন্ধ রাখায় আয়ের পথ হারিয়ে এসব ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন- গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর দেওয়া টানা তিন মাসের লকডাউনে বড় ধাক্কা লাগে ব্যবসায়। এই ধাক্কা কাটাতে বড় বড় ব্যবসায়ী এবং কারখানার মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রণোদনা পেলেও খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এই প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হন।

প্রণোদনা বঞ্চিত হলেও বছরের শেষ দিকে সংক্রমণ কমে আসায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু করেন এসব ব্যবসায়ী। অনেকে জমি-স্বর্ণ বিক্রি করে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নতুন করে পুঁজিও দেন। তবে গত রমজানের ভরা মৌসুমে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ কমাতে দেওয়া ফের লকডাউনে ভেঙে পড়ে তাদের সেই প্রচেষ্টা।

ঈদুল ফিতরের কয়েকদিন আগে লকডাউন শিথিল করা হলেও এরপর ধাপে ধাপে দেওয়া লকডাউনে এখনো বন্ধ রয়েছে খুদে ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা বন্ধ থাকায় সাড়ে তিন লাখ খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে জীবিকা নিয়ে গভীর সংকটে পড়েছেন অন্তত দশ লাখ কর্মচারী।

নগরীতে সবচেয়ে বেশি খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ী রয়েছেন রিয়াজুদ্দিন বাজার, টেরিবাজার, চকবাজার এবং নিউ মার্কেট এলাকায়। এসব এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন- লকডাউনে বিধিনিষেধ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার দ্বৈতনীতি নিয়েছে। বড় ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে প্রণোদনা এবং কারখানা খোলার অনুমতি দিলেও খুদে ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে সরকার কঠোর হচ্ছে।

রিয়াজুদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হাসেম পূর্বকোণকে বলেন, দেশ ভাইরাসের সংক্রমণের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। এ কারণে পথে বসার উপক্রম হলেও বিধিনিষেধ মেনে আমরা দোকান বন্ধ রেখেছি। কিন্তু দোকান বন্ধ রেখে কারখানাগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কেনো? কারখানায় কি সংক্রমণ হয় না। এক দেশে দুই নীতি হলে মানুষের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়বে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ পূর্বকোণকে বলেন, খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আয় বন্ধ হলেও খরচ থেমে নেই। কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, আয়কর, সেবা সংস্থাগুলোর বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দিশেহারা তারা। এই অবস্থায় সবাইকে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব না হলেও স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদের এসএমই ব্যাংক লোন দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, জীবন সুরক্ষায় সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে তা আমরা মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু এতো মানুষের জীবিকার কথাও সরকারকে ভাবতে হবে। আয়কর, ভ্যাট, বিদ্যুৎ বিল কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যারা এখনো এসব পরিশোধ করতে পারেননি তাদের সুদ মওকুফ করা প্রয়োজন। নয়তো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হবেন। দেশে বেকারের পরিমাণ বেড়ে যাবে। যা অর্থনীতিকে ধংস করবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট