চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

জানা যাবে হালদার মাছ ও ডলফিনের জীবনরহস্য

মোহাম্মদ আলী 

৩১ জুলাই, ২০২১ | ১২:৩৮ অপরাহ্ণ

এবারই প্রথম হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছ ও ডলফিনের জীবনরহস্য নিয়ে গবেষণা করছে একদল গবেষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি অধীনে এ গবেষণা কার্যক্রম চলছে। দুই বছর মেয়াদী গবেষণাটি এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খুব সহসা গবেষণার ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সহযোগিতা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)।

গবেষকরা জানান, হালদা নদীর রুই জাতীয় ৪টি মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ও ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাসের উপর গবেষণা কার্যক্রমে নিউজিল্যান্ড ও চীনের দুই গবেষকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের ৮ ছাত্রও জড়িত রয়েছেন। গবেষণার বিষয় হচ্ছে- ‘হোল জিনোম সিকুয়েন্সিং অব ইন্ডিয়ান মেজর কার্পস (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) এবং গাঙ্গেয় ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস’। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া এ গবেষণার কাজ বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটা নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক।

এই প্রাকৃতিক জিন পুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রগুলোতে ইনব্রিডিং-এর কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মাছের বামনত্ব, বিকলাঙ্গতাসহ বিভিন্ন ধরনের জিনগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দ্রুত বর্ধনশীল বড় আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছ এক সময় রূপকথার গল্পের মত মনে হবে। তাই এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করার বিকল্প নেই। এছাড়া শুশুক বা ডলফিন আইইউসিএন এর রেডলিস্ট অনুযায়ী বিপন্ন তালিকার জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটি শুশুক, শিশু, হুস্তুম মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন নামেও পরিচিত। এই শুশুক বা ডলফিনের নামকরণ, ইতিহাস ও বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভারতের গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এদের বাসস্থান হওয়ার কথা। ভৌগলিকভাবে হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীর অবস্থান অনুযায়ী গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোর সাথে চট্টগ্রামের এই নদীগুলোর কোন সংযোগ নেই। এমনকি অতীতেও সংযুক্ত থাকার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীতে এই ডলফিনের আগমন, বিস্তৃতি এবং অবস্থান এখনো রহস্যাবৃত। আদৌ এই শুশুক বা ডলফিনগুলো প্লাটানিস্টা গাঞ্জেটিকা প্রজাতির কিনা তা পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমে জানা যাবে।’

মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু ফিশারিজ হেরিটেজ’ ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এই ঘোষণা বাংলাদেশের নদী রক্ষার ক্ষেত্রে হালদা নদী একটি অনন্য উদাহরণ। সুতরাং হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু ফিশারিজ হেরিটেজ’ হিসেবে আলোচ্য পাঁচটি প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমে নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও গবেষণায় নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে।’

গবেষণায় টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সের বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. জোনায়েদ সিদ্দিকী। দৈনিক পূর্বকোণকে তিনি বলেন, হালদা, ইন্ডিয়ান মেজর কার্পসমূহের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র যা এ নদীকে করেছে অনন্য। রুই এবং অন্যান্য কার্পসমূহের জীনগতভাবে বিশুদ্ধ নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায় বলে এ নদীটি একটি স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছে। একই সাথে এ নদীটি তীরবর্তী অসংখ্য ডিম সংগ্রহকারীর জীবন ধারনের পাথেয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রায় ৫০ বছর পূর্বে এ নদী থেকে ৪০-৫০ কেজি ওজনের মেজর কার্পসমূহের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা গেলেও বর্তমানে এর পরিমাণ কমেছে অনেকখানি। প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে এ নদীর পরিবেশ ক্রমশ ডিম ছাড়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, শাখা নদীসমূহে স্লুইস গেট ও রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং মা মাছ শিকারের ফলে এ নদীর মাছের পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

অপরদিকে, দেশে একুয়া কালচারের প্রয়োজনীতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাছের রেণুর চাহিদাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ মাছের জীনগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন প্রদক্ষেপ ইতোপূর্বে নেয়া হয়নি। প্রাকৃতিক পরিবেশে এ ইন্ডিয়ান মেজর কার্প সংরক্ষণের জন্য এদের জীনগত গঠন এবং বৈশিষ্ট্য জানা অত্যাবশ্যক। তাছাড়াও এ প্রকল্পের মাধ্যমে হালদা নদীর কার্পসমূহের ব্র্যান্ডিং সুনিশ্চিত হবে যা বাণিজ্যিক ও উদ্যোক্তা তৈরিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জীনগত গবেষণার জন্য সাধারণত মা মাছের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়ে থাকে। কেননা পরবর্তীতে হ্যাচারির মাছসমূহের গুণগত মান নির্ধারণের জন্য এ গবেষণালব্ধ ফল মানদ- হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে হোল জিনোম সিকুয়েন্সিং একটি অন্যতম পন্থা।

এ গবেষণের মাধ্যমে হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছসমূহের ট্রান্স কিপ্টোম এবং এদের গুরুত্বপূর্ণ স্বতন্ত্র জীনসমূহকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীসমূহ জলজ পরিবেশে ঠিকে থাকার জন্য নিজেদের মধ্যে বিভিন্নভাবে অভিযোজিত হয়ে থাকে। জলজ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে শুশুকের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শুশুক (বিশেষ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শুশুক) প্রতিনিয়ত মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকা- যেমন পানি দূষণ, নদীতে অতিরিক্ত নৌ চলাচল, শুষ্ক মৌসুমে পানির স্রোত হ্রাস এবং বাসস্থানের ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন কারণে এ প্রজাতিটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। সে কারণে শুশুকের এ প্রজাতি টিকে বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এ প্রাণীটি সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য হোল জিনোম সিকুয়েন্সিং একটি অন্যতম পন্থা। এ গবেষণার ফলে আমরা গাঙ্গেয় শুশুকের ট্রান্স কিপ্টোম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জীন সম্পর্কে জানতে পারবো।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট