চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জাতীয় স্বার্থে বাঁচাতে হবে কর্ণফুলীকে

এস এম ওমর ফারুক

২৯ জুলাই, ২০২১ | ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা কিংবা হৃদপিণ্ড যাই বলি না কেন নিঃসন্দেহে সেটি হল কর্ণফুলী নদী। বৈধতার মোড়কে কিংবা অবৈধভাবে প্রকাশ্যে দখলে চলে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর পাড়। সংকুচিত হয়ে নদীর প্রবাহকে বিঘ্নিত করে পুরো চট্টগ্রাম বন্দর এবং চট্টগ্রাম শহরকেই বিপর্যস্ত করে তুলছে এই সকল প্রক্রিয়া।

সকলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে দূষণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নযজ্ঞ। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে হাইকোর্টের আদেশের পরে নদী দখলকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই তালিকায় দেখা যায়, কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে ২,১১২ দখলদার। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার বহুবার ‘নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দেওয়ার’ অঙ্গীকার পুনঃ পুনঃ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দখলদারিত্বের সাথে অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় রাঘববোয়ালদের সংশ্লিষ্টতার খবর চাউর হওয়ার মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া থমকে যায়।

সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কর্ণফুলী নদী রক্ষা করা যাবে কিনা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘সঙ্ঘবদ্ধ কিছু মানুষের লোভ আমাদের এই নদীকে গলা টিপে হত্যা করছে। এই চক্রে যেমন ভূমিদস্যু রয়েছে, তেমনি রয়েছেন কিছু অর্থলোভী রাজনীতিবিদ। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় তারা কর্ণফুলীকে হত্যা করে চলেছে।’ লুসাই পাহাড় থেকে আশা কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশ সীমানায় প্রায় ২৭০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে।

উৎস থেকে যতই ভাটির দিকে এসেছে ততোই নদীর দুকূল দখলদারদের করাল গ্রাসে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এক সময়ে নদীর প্রস্থ সাড়ে সাতশ মিটারের বেশি ছিল যা বর্তমানে দখলে সংকুচিত হয়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ মিটারে নেমে এসেছে। দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশের পরও কর্ণফুলীর পাড়ে তিন হাজারেরও বেশি স্থাপনা নানাভাবে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে।

প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, মালয়েশিয়ান একটা কোম্পানির মাধ্যমে নদীর ড্রেজিং করতে গিয়েও নদী ভরাট করেছে। নদীর মাটি বিক্রি করার জন্য মালয়েশিয়ান কোম্পানির  স্থানীয় এজেন্ট প্রভাবশালীদের যোগসাজশে নদীর পাড় এমনভাবে ভরাট করেছে যাতে দেশের অর্থনীতি এ প্রাণপ্রবাহের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।

এছাড়া কর্ণফুলী নদীর ওপারের পটিয়ার কোলাগাঁও গ্রামে এক কিলোমিটারের মধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। নদীর তীর দখল করে চলছে এগুলোর কার্যক্রম। নদীর তীর দখলের পর নদীর মাঝ পথ দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল সঞ্চালনের আনলোডিং স্টেশন। স্থায়ী ও পাকা স্থাপনা নির্মাণের কারণে নদীতে পলি জমাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কর্ণফুলী নদী দূষণ প্রতিরোধ এবং এটি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের। এই অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে ৩০০টির অধিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর অধিকাংশের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৭০ লক্ষ মানুষের জন্য কোন বর্জ্যব্যবস্থাপনা বা এসটিপি নেই। ফলে নগরীর বাসিন্দাদের মলমূত্রের বর্জ্যগুলো সংযুক্ত খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে এসে দূষণ সৃষ্টি করছে। তবে আশার কথা হলো চট্টগ্রাম ওয়াসা দেরিতে হলেও চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্যে এসটিপি বা সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে আশা করা যায় মানববর্জ্য দ্বারা সংঘটিত দূষণ কমে আসবে।

এছাড়া কর্ণফুলী নদীর নাব্যতার জন্য আরেকটি বড় হুমকি হচ্ছে চট্টগ্রামের ৭০ লক্ষ নাগরিকের ব্যবহৃত পলিথিন। এক পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে প্রতিমাসে দেড় কোটিরও বেশি পলিথিন পড়ছে। যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে নালা নর্দমা নিয়মিত পরিস্কার করে পলিথিন মুক্ত করতে হবে নগরীকে।

বর্জ্য ও দূষিত পদার্থের পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০০ জাহাজ চলাচল করে থাকে যা অন্যদিকে দূষণে ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতি ১০ বছর অন্তর কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ থাকলেও তা হয়নি নানা কারণে। বর্তমানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর একটি প্রকল্পের কাজ চললেও পলিথিন বিপত্তিতে পুরো প্রকল্প টি হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে জানা যায়।

‘সদরঘাট টু বাকলিয়া চর ড্রেজিং’ নামের এ প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলনের কথা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দেখা যাচ্ছে অভয়মিত্র ঘাট হতে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে নদী থেকে উত্তোলিত মাটি ও বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। পাশাপাশি অভয়মিত্র ঘাট অংশে নদীর ভিতর একটি জেটিও নির্মাণ করা হচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশে উচ্ছেদ এর পরিবর্তে নতুন করে কেন ভরাট করা হচ্ছে বা কেন নতুন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।

সার্বিকভাবে বলা চলে, দখল-দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদী তার নাব্যতা হারিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে জোয়ারের পানিতে শহরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কর্ণফুলীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার ওপর চলতি বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিকে কর্ণফুলী তার নাব্যতা হারাবে অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের নতুন নতুন এলাকা জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বলা বাহুল্য ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জে প্রতিবছর কর্ণফুলীর বিরূপ প্রভাবে জলমগ্ন হয়ে শত শত কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হচ্ছে।

এমতাবস্থায় কর্ণফুলী রক্ষায় জাতীয় নদী কমিশন ও সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে, নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা সকল স্থাপনা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে, নতুন করে কেউ যেন নদীর তীর দখলের সাহস না দেখায় তার জন্য কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, মানববর্জ্য এর জন্য ওয়াসার গৃহীত এসটিপি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সহ সকল সংস্থাকে শহরকে পলিথিন মুক্ত করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলীর শাখা খালগুলো দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই কর্ণফুলী নদী ও তৎসংলগ্ন চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এ বন্দরকে সচল রাখতে হলে এ নদীকে জীবন্ত রাখতে হবে। এ শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে কর্ণফুলী নদীর দখলকৃত ভূমি নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দল মত নির্বিশেষে চট্টগ্রামের এবং দেশের সর্বস্তরের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, স্টোকহোল্ডারসহ সকল নাগরিককে এই নদী রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: এস এম ওমর ফারুক শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট