চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

আস্থা বাড়ছে পাহাড়ের আমে

নিজাম উদ্দিন লাভলু, রামগড়

১৯ জুন, ২০২১ | ৩:৫৪ অপরাহ্ণ

এক সময়ের জুম ভূমি অথবা বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ অনাবাদি পাহাড়ি টিলায় এখন সারি সারি আম বাগান। আম্রপালিসহ বিভিন্ন জাতের থোকায় থোকায় আম দোল খাচ্ছে গাছে গাছে। ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে আম গাছের ডালপালা। চারিদিকে আমের সুগন্ধি। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের ছোট বড় সব আম বাগানে এখন এমনই নজরকাড়া দৃশ্য। বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম জাপানের মিয়াজাকিসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের আম চাষ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর অধিকাংশই দখল করে নিয়েছে ভারতীয় আম্রপালি আম। পাহাড়ের চাষিরা এখানে আম বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এক সময়ের সমতল জেলা থেকে আসা আমে চাহিদা মেটাতো পাহাড়ের মানুষ।

এখন রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মত এ পার্বত্য এলাকায়ও আমের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিক পরিকল্পিত আম চাষ করে পাহাড়ে উন্নত জাতের আম উৎপাদনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেন চাষিরা। শুধু সরকারি সাহায্য সহায়তায় নয়, চাষিরা নিজেদের কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় পাহাড়ের অনাবাদি টিলায় উন্নত জাতের আম চাষে ঈর্ষণীয় সফলতা এনেছে।  গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের সফল আম চাষি মো. আলী জানান, এক সময় দিন মজুরি করে অনেক কষ্টে তার সংসার চলতো। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় ২০০১ সালে তিনি নিজস্ব পাহাড়ি টিলা ভূমিতে আম বাগান করে এখন আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল।  গত বছর আম বিক্রি করে প্রায় ৬ লাখ টাকা লাভ করেন।

এবছর ফলন খুব ভাল হওয়ায় লাভও অনেক বেশি হবে বলে জানালেন তিনি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার তিন পার্বত্য জেলায় ১৩ হাজার ৩৪২ হেক্টর পাহাড়ি টিলায় আম চাষ হয়েছে। আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক লক্ষ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। তন্মধ্যে খাগড়াছড়িতে ৩ হাজার ৩৬৯ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, রাঙামাটিতে  ২ হাজার ৩৯২ হেক্টরে ২৬ হাজার ৩১২ মেট্রিক টন এবং বান্দরবানে ৭ হাজার ৫৮১ হেক্টরে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি আম বাগান রয়েছে।

বাণিজ্যিক ভিত্তিক বড় বড় এগ্রো ফার্মের অধিকাংশ বাগানই এ জেলায় অবস্থিত। রাঙামাটি ও বান্দরবানের তুলনায় এবার খাগড়াছড়িতে ফলন অনেক ভালো হয়েছে। ফরমালিন মুক্ত হওয়ায়  পাহাড়ের আমের কদর রয়েছে সারাদেশে। তাই পার্বত্য এলাকার সীমানা পেরিয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন সমতল জেলায় সরবরাহ হচ্ছে এখানকার  আম। ঢাকা ও চট্টগ্রামের নামিদামি শপিং শপেও পাহাড়ের আম বিক্রি হচ্ছে। আম্রপালি, মল্লিকা, রাংগুই,  বারি-৪সহ  সব জাতের আমের ফলনই এবছর ভালো হয়েছে। বিভিন্ন আম বাগান সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, চাষিরা স্ত্রী পুত্র কন্যাদের নিয়ে গাছ থেকে আম পারছেন। প্রতিটি আম্রপালি গাছে গড়ে ৫০ কেজির মত আম ধরেছে।  চলিত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই  আম্রপালি তোলা শুরু হয়। খাগড়াছড়িতে ভালো মানের আ¤্রপালি খুচরা বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫৫-৬০ টাকা এবং পাইকারি ৪৫-৫০ টাকা দরে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লার পাইকারি ব্যবসায়ীরাই বাগানের সিংহভাগ আম কিনে নিয়ে যায়। এ বছর অনলাইনের মাধ্যমেও আম বিকিকিনি চলছে। চাষিরা বাগানের আমে ফরমালিন বা কোন বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করেন না। বিষমুক্ত হওয়ায় এখানকার বাগানগুলোর আমের চাহিদাও সকলের কাছে বেশি। 

১৯৯৮-৯৯ সালে কালিকাপুর মডেল প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ে আ¤্রপালি আমের আবাদ শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে চাষিদের বিনামূল্যে চারা, সার  ইত্যাদি দিয়ে আম চাষে উদ্বুদ্ধ করে। কম সময়ে ফলন, অধিক উৎপাদন, সুস্বাদু ও বাজারে বেশ চাহিদা দেখা দেয়ায় ক্রমশ বাগান সম্প্রসারণ হতে থাকে। এক সময়ে নিজ উদ্যোগেই এখানে হাজার হাজার একর আম বাগান গড়ে উঠে । কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপ পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ভালো ফলন ও অধিক লাভজনক হওয়ায় পাহাড়ের মানুষ আম চাষে ঝুঁকে পড়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ জুলফিকার আলী ফিরোজ বলেন, পার্বত্য এলাকার মাটি ও আবহাওয়া বিভিন্ন জাতের আম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তিনি বলেন, পাহাড়ে উৎপাদিত আমের অধিক ব্যবহারের জন্য আম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন এবং সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ জরুরি। এতে  চাষিরা ফলের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং বিপুল পরিমাণ ফল নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট