চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রথমেই বৈধ কাগজপত্র প্রদানের মারপ্যাচ, ঠারেঠোরে বুঝেন বাড়তি টাকাতেই রেহায়

জন্ম নিবন্ধন সনদ: বাহক পর্যায়েই যত বিড়ম্বনা

সারোয়ার আহমদ

১৯ জুন, ২০২১ | ১:০৬ অপরাহ্ণ

জন্ম নিবন্ধন সনদ পেতে যত ধরনের বিড়ম্বনা বা ভোগান্তি তার সবই হয় বাহক পর্যায়ে। একজন জন্ম নিবন্ধনের আবেদনকারী প্রথমে আবেদন করতে গিয়েই বৈধ কাগজপত্র প্রদানের মারপ্যাচে পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকেন। ওই ব্যক্তি কোন উপায় না পেয়ে ঠারেঠোরে বুঝে নেন বাড়তি টাকায় রেহাই পাওয়া যাবে এই ভোগান্তি থেকে। আর এতেই ৫০ টাকার জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য ব্যয় করতে হয় ৫০০ টাকা। যা ক্ষেত্র বিশেষে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়া যায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এছাড়া জন্মের ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্য ২৫ টাকা এবং ৫ বছরের বেশি বয়সীদের ৫০ টাকায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যুর বিধান রয়েছে।
এদিকে জন্ম নিবন্ধনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় নিয়ন্ত্রিত অনলাইন আবেদন পদ্ধতিতে রয়েছে এর সুস্পষ্ট বর্ণনা। ওয়েব সাইটে আবেদনের বিভিন্ন ধাপে বলা হয়েছে আবেদনকারীর পরিচয় বা ঠিকানা প্রমাণের জন্য কি কি কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এছাড়া এ নিয়ে সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ ও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৮ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। যেখানে জন্ম নিবন্ধনের বিভিন্ন নিয়ম-নীতিও দেয়া আছে। এসব নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে আবেদন করতে গেলে যে নথিপত্রের কথা বলা হয় তা হলো- ‘চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত জন্ম সংক্রান্ত সনদের সত্যায়িত কপি বা পূরণকৃত আবেদনপত্রে বার্থ এটেন্ডের প্রত্যায়ন বা ইপিআই কার্ডের (টিকা কার্ড) সত্যায়িত অনুলিপি।
পিতা / মাতা/ পিতামহ / পিতামহীর দ্বারা স্বনামে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঘোষিত আবাস স্থলের বিপরীতে হালনাগাদ কর পরিশোধের প্রমাণপত্র বা পিতা / মাতা/ পিতামহ / পিতামহীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট ঘোষিত স্থায়ী ঠিকানা বা জমি অথবা বাড়ি ক্রয়ের দলিল, খাজনা ও কর পরিশোধ রশিদ। (নদীভাঙ্গন অন্য কোন কারণে স্থায়ী ঠিকানা বিলুপ্ত হলে)’।

অনলাইন আবেদনে এসব কাগজের যে কোন একটির কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে উল্লেখিত সব কাগজই চাওয়া হয়। অনেকে আবার নিজ উদ্যোগে জন্ম তারিখ ও ঠিকানার প্রমাণপত্র হিসেবে অন্যান্য কাগজপত্রও চেয়ে থাকেন। যেমন বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল ইত্যাদি। এসব থেকে রেহাই পেতে একজন জন্ম নিবন্ধন আবেদনকারী ভিন্ন পথ খুঁজতে থাকেন। অনেকে ব্যর্থ হয়ে আবেদন না করেই ফিরে যান।

এদিকে কাউন্সিরগণ বলছেন, জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় নিবন্ধন হওয়ার পেছনে কাউন্সিলরদের প্রদত্ত জন্ম সনদকে দায়ী করে জেল পর্যন্তও খাটতে হয়েছে। তাই জন্ম সনদ ইস্যুতে স্থায়ী ঠিকানা শতভাগ নিশ্চিতে জমির দলিল বা খাজনা এবং কর পরিশোধ রশিদ চাওয়া হয়। এছাড়া অনেকে সরকারি চাকরি বা বাল্যবিয়ের জন্য বয়স পরিবর্তন করতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। এ কারণে জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করতে শতভাগ পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাউন্সিলরেরা জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করেন না।

জানতে চাইলে ৭নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী পূর্বকোণকে বলেন, জন্ম নিবন্ধন সনদে নতুন করে স্থায়ী ঠিকানার সনদ বাধ্যতামূলক করার কারণে মানুষ কিছুটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে শহরে থাকেন। এখানকার ভোটারও হয়ে গেছেন। তাই গ্রামের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তাদেরকে এখন জন্ম নিবন্ধনের জন্য গ্রামে যেতে হচ্ছে। এসব ডকুমেন্ট যোগাড় করতে সময় লাগছে এবং ভোগান্তিরও শিকার হচ্ছেন। শর্তগুলো আরো সহজ করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, পিতা-মাতার এনআইডি কার্ড দেখে জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে এনআইডি কার্ড যাচাই করার সুযোগ নেই। ওয়ার্ড পর্যায়ে এনআইডি কার্ড যাচাই করার সুযোগ দিয়ে শর্ত সহজ করলে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমতো।
একাধিক ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, যাদের জন্ম ২০০০ সালের পরে তাদের জন্মনিবন্ধন করতে গেলে মা বাবার জন্মনিবন্ধন চাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে তার বাবার স্থায়ী ঠিকানার চৌকিদারি ট্যাক্স, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সনদ এবং খতিয়ান প্রয়োজন হচ্ছে। এসব ডকুমেন্ট নিয়ে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন করে তারপর সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা হচ্ছে। শহরে বিভিন্ন জেলার মানুষ বসবাস করেন। তাদেরকে আবার নিজ এলাকায় গিয়ে এসব সনদ নিয়ে আসতে হচ্ছে। কারো পিতা-মাতা মারা গেলে প্রথমে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হচ্ছে। মৃত্যু নিবন্ধন করতে হলে প্রথমে মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন করতে হয়। তারপর মৃত্যু নিবন্ধন করতে হয়। সরকার পরিপত্র জারি করেছে যেকোন ধরনের ওয়ারিশ সনদ প্রদানের আগে অনলাইন মৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এটি ২০০৬ সালের পর যারা মারা গেছেন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে আরো নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। অতীতে যারা বাংলায় জন্ম নিবন্ধন নিয়েছে, এখন তাদের নামের বানান ইংরেজিতে ভুল আসছে। এটি সংশোধন করার জন্য জেলা প্রশাসনের অফিসে পাঠাতে হয়। সেখান থেকে অনুমোদন হলে ওয়ার্ড অফিস থেকে সংশোধন করার সুযোগ হয়। ফি দিয়ে এই আবেদন করতে হয়। এজন্যও দীর্ঘসূত্রিতা হয়। আবার যারা ইংরেজিতে নিয়েছে তাদের বাংলা বানান ভুল হচ্ছে।
এসব ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করার প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করার দাবি সাধারণ মানুষের।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট