চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রক্তদানেই ওদের আনন্দ

মোহাম্মদ আলী 

১৪ জুন, ২০২১ | ১২:৩৯ অপরাহ্ণ

মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। তাদের রক্তে বেঁচে যাচ্ছে এক একটি মূল্যবান জীবন। রক্ত দিয়ে মনের প্রশান্তি পেতে শুধু দিনের বেলায় নয়, গভীর রাতেও হাসপাতালে ছুটে যান এক ঝাঁক মানবিক মানুষ। বছরের পর বছর ধরে তাদের মানবিকতার পরিধি যেমন বাড়ছে, বাড়ছে রক্তদাতার সংখ্যাও। দৃষ্টান্তকারী এমনি চার রক্তদাতা হলেন, কল্যাণ দাশ, ডা. কাজী মেহেনাজ আশা, সাবিনা আকতার ও নাজমা চৌধুরী। যাদের তিনজনই তরুণ।

১৯৮৯ সালে সরকারি সিটি কলেজে ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্র থাকাবস্থায় জীবনে প্রথম রক্তদান করেন কল্যাণ দাশ। এরপর থেকে আজ অবধি ৩৩ বছরে তিনি প্রায় ১০০ বার রক্তদান করেন। কোন কিছুর বিনিময়ে নয়, শুধুমাত্র মনের প্রশান্তির জন্য রক্ত দেন তিনি। দৈনিক পূর্বকোণকে তিনি বলেন, ‘রক্ত দেওয়ার পর রোগী ও স্বজনের মুখে একটু হাসি দেখলে খুবই ভাল লাগে। মূলত এ নেশা থেকে রক্তের ফেরি করে বেড়াই’।

পেশায় ব্যবসায়ী কল্যাণ দাশ, রক্তের গ্রুপ বি-পজেটিভ। জীবনের প্রথম দিকে সন্ধানী ও লিও ক্লাবের মাধ্যমে রক্ত দিয়ে আসলেও পরবর্তীতে থেলাসেমিয়া, লিউকেমিয়া ও ব্লাড ক্যান্সার রোগীকে রক্ত দিয়েছেন বেশি। কলাাণ দাশের মতো ছাত্র অবস্থায় প্রথম রক্তদান করেন ডেন্টিস্ট ডা. কাজী মেহেনাজ আশা। চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী থাকাবস্থায় ২০০৬ সাল থেকে তিনি রক্ত দিয়ে আসছেন। ওই সময় এক প্রসূতি রোগীকে তিনি প্রথমবার রক্ত দেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ২৪ বার রক্তদান করেন তিনি। তার রক্তের গ্রুপ বি-পজেটিভ।

রক্ত দিতে গিয়ে ডা. কাজী মেহেনাজ আশা’র একদিকে মধুর অভিজ্ঞতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতাও। একবার এক প্রসূতি মা’র ডেলিভারির সময়ে রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন তিনি। এরপর প্রসূতি মায়ের দুটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে। খুশিতে প্রসূতি পরিবার তাকে একটি শিশুর নামকরণের প্রস্তাব দেন। এ ঘটনায় খুবই খুশি হন ডা. মেহেনাজ। এ রকম বহু স্মৃতির কথা উল্লেখ করে ডা. মেহেনাজ বলেন, ‘রক্ত দেওয়ার আগে রোগীর স্বজনরা যেভাবে খবর নিয়ে থাকেন, রক্ত দেওয়ার পর অনেকে কোন খবরও নেন না। এতে মনে কষ্ট লাগে। এমনকি হাসপাতালে রক্ত দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরলেও অনেকে সৌজন্যের খাতিরে একটিবারের জন্য ফোনে খবর নেন না। তারপরও মানবিকতার কারণে রক্ত দিই। কোন কিছু পাওয়ার আশা নয়, মূলত মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত দিতে এগিয়ে যাই’।

ডা. মেহেনাজের মতো রক্ত দেওয়ার মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতাও রয়েছে সাবিনা আকতারের। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত এ নারী ২০১২ সালে নিজের ১৮তম জন্মবার্ষিকীতে প্রথমবার রক্তদান করেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৩০ বার রক্ত দেন। তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজেটিভ।

রক্তদানের উৎসাহের কথা জানাতে গিয়ে সাবিনা আকতার দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন. ‘আমার বয়স তখন আড়াই বছর। আমার মা একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অনেকে রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলেন। বুদ্ধি হওয়ার পর এসব ঘটনা শোনে মনে মনে সংকল্প করেছি বড় হয়ে আমিও মানুষের বিপদে রক্তদান করবো। সেই ১৮ বছর বয়স থেকে আমি এ পর্যন্ত ৩০ বার রক্তদান করেছি’।

সাবিনা আকতার বলেন, ‘একবার ডেলিভারি রোগীকে রক্ত দিতে গিয়ে খুশি হন রোগীর স্বামী। তার দেখাদেখিতে ওই ব্যক্তি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্যকে রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আমার খুব ভাল লাগে। রক্ত দিতে আরো উৎসাহী হয়ে উঠি’।

রক্তদানে আরেক দৃষ্টান্তকারী নাজমা চৌধুরী। নগরীর মোহরা সায়েরা খাতুন কাদেরিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। ২০১৬ সালে তিনি জীবনে প্রথম রক্তদান করেন। দৈনিক পূর্বকোণকে ওই শিক্ষিকা বলেন, ‘একটি শিশুর জন্য রক্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয় ‘সিটিজি ব্লাড ব্যাংক’। ওই শিশুর রক্তের গ্রুপ ‘এ’ নেগেটিভ। তার সাথে আমার রক্তের গ্রুপ মিল রয়েছে। তাই আমি দেখলাম কয়েক ঘণ্টা পরও রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আমি উদ্যোগী হয়ে রাতে আমার ছোট ভাইকে নিয়ে আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চলে যাই। দুর্ঘটনায় সংকটাপন্ন ওই শিশুকে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করি। এরপর থেকে আমি সবসময় রক্ত দিয়ে আসছি। এ পর্যন্ত আমি ১৫ বার রক্তদান করেছি’।

এদিকে বিশ্ব রক্তদান দিবস প্রসঙ্গে জীবনে ২৭ বার রক্তদান করা সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের এডমিন প্রকৌশলী সূর্য দাস দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ এবিও ব্লাড গ্রুপ সিস্টেম আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেখান বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। ১৪ জুন তাঁর জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে জন্মদিনটি ঘিরে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালন করা হয়। কার্ল রক্তের গ্রুপগুলো শনাক্ত করার আগে বিভিন্ন রক্তের গ্রুপগুলো না জেনে রক্ত ​​সঞ্চালন করত। এই আবিষ্কার কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারকে ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার জিতিয়ে দেয়’।

রক্তদানে নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কল্যাণ দাশ, ডা. কাজী মেহেনাজ আশা, সাবিনা আকতার ও নাজমা চৌধুরী বলেন, ‘কোন কিছুর বিনিময়ে নয়, মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে কোন কোন সময় দেখা যায়, রক্ত নেওয়ার আগে যেভাবে রোগীর স্বজনরা রক্তদাতার খবর নেন, রক্তদানের পরপরই তার কোন খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না। এতে রক্তদাতা স্বাভাবিকভাবে মনে কষ্ট পান। তাই বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নিয়ে রক্তদাতাকে উৎসাহ দিলে তিনি যেমন আরো রক্ত দিতে উৎসাহী হবেন, অন্যরা এ মানবিক কাজে এগিয়ে আসবেন। তাছাড়া স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রক্তদানের উপকারিতা ও রোগীর জীবন বাঁচানোর বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। তাতে ছাত্রজীবন থেকে মানুষ রক্তদানে উৎসাহী হবেন’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট