চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

খাদ্যের ভূত না তাড়ানোর খেসারত

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১১ মে, ২০২১ | ১২:২৯ অপরাহ্ণ

খাদ্য বিভাগের দেয়ালও যেন ঘুষ খায়। পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে ভূত। দীর্ঘদিন ধরে এই ভূত না তাড়ানোর কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম ঠেকানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ ভূত এখন শস্যে নয়, ভূত লুকিয়ে আছে খাদ্য বিভাগে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে পরিবহন ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মিলে গিলে খাচ্ছে খাদ্য বিভাগকে। খাদ্য বিভাগের একটি তদন্ত কমিটিও সরকারি চাল বস্তা পাল্টিয়ে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে। গত বছরও সরকারি ত্রাণের চাল বস্তা পাল্টানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এক ব্যবসায়ীকে। দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা ভূত না তাড়ানোর খেসারত দিতে হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তরকে।

গত দুই বছর ধরে দৈনিক পূর্বকোণ ‘চাল চালাচালিতে ‘সাগরচুরি’, ‘দুই ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে সরকারি গুদামের চাল’, ‘বিড়াল দিয়ে শুঁটকি পাহারা’-শিরোনামে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদনে খাদ্য গুদামের চাল পাল্টানো ও চাল পাচার, অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ওঠেছিল। সরকারের চোখে ধুলা দিয়ে গবিরের ত্রাণ-খাদ্যবান্ধর চাল নিয়ে পুতুল খেলা খেলে আসছিলেন একটি সিন্ডিকেট। এসব প্রতিবেদন আমলে নেয়নি সরকার। টনক নড়েনি খাদ্য বিভাগের। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গোঁজামিল ও চাল চালাচালিও রোধ করা যায়নি।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মো. শফিউল আজম বলেন, ‘খাদ্য বিভাগের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছি।’

একাধিক সূত্র জানায়, দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্য গুদামের উন্নতমানের সরকারি চাল পাল্টিয়ে নিম্নমানের চাল পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ডিও ব্যবসার আড়ালে পাহাড়তলী ও চাক্তাইকেন্দ্রীক ৫-৭ জনের একটি সিন্ডিকেট এই গোঁজামিল করে আসছেন। বিশেষ করে পাহাড়তলী চাল বাজারের পাঁচ ব্যবসায়ী হচ্ছেন চাল পাল্টানো সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা। দুই খাদ্য গুদামের ম্যানেজার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে চলে আসছে এই অনিয়ম ও দুর্নীতি। তাদের মধ্যে দুই ব্যবসায়ী চাল পাচার ও চালাচালি করেই কোটিপতি বনেছেন। দেশের অন্যতম দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্য গুদাম শাহাব উদ্দিন ও আলমের কব্জায় বন্দী বলে জানায় একাধিক সূত্র।

গত ২১ এপ্রিল পাহাড়তলী বাজার থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সরকারি ৭০ হাজার কেজি চাল জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় চাল ব্যবসায়ী বাহার মিয়াকে। এসব চাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে নোয়াখালীর চরভাটা এলএসডি খাদ্য গুদামে যাওয়ার কথা ছিল।

এই ঘটনায় গঠিত খাদ্য বিভাগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জব্দ করা সরকারি উন্নতমানের চাল বস্তা পাল্টিয়ে নিম্নমানের চাল বস্তাভর্তি করে গুদামের পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় দুই লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করেছে সরকার। আমদানি করা এসব চালের মধ্যে কী পরিমাণ চালের বস্তা পাল্টানো হয়েছে তা বের করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি গুদাম থেকে চাল পাচারকালে বিপুল সংখ্যক চাল আটক করেছিল র‌্যাব। এসময় গুদাম ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই ঘটনায় খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা, পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিন ও ট্রাকচালকসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। পরবর্তীতে খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা পুনরায় স্বপদে বহাল হন। ফখরুল এখনো দাপটের সঙ্গে পুরোনো কায়দায় অনিয়মে জড়িত আছেন বলে খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

ব্যবসায়ী বাহার মিয়া হচ্ছেন সিন্ডিকেটের প্রধান শাহাব উদ্দিনের ছোট ভাই। বড় ভাইয়ের হাত ধরে খাদ্য বিভাগের জালিয়াতি কাজে পটু হন বাহার মিয়া।

এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘চালগুলো কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে-তা আমরা কিছুই জানি না।’

নওগাঁ, দিনাজপুর, নেত্রকোণা ও আশুগঞ্জের চালের মান ভালো। এসব অঞ্চলের চালের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকে চাল ব্যবসায়ী চক্রের। এসব অঞ্চলের চালের কদর বেশি হওয়ায় পাচার দরও একটু বেশি হয়।

পাহাড়তলী চাল বাজারের চাল ব্যবসায়ী খাজা ভা-ারের মো. শাহাব উদ্দিন, তার ব্যবসায়ী অংশীদার মো. আলমের (পটিয়ার আলম) কবজায় নগরীর দুই সিএসডি গুদাম। ডিও ব্যবসায় অন্তরালে দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্য গুদাম নিজের মতো করে ব্যবহার করেন তারা। সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতের মুঠোয়।

শাহাব উদ্দিন দাবি করেন, ‘সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর প্রকল্পের চাল আমরা কিনে নিই। ডকুমেন্টের ভিত্তিতে ব্যবসা করি। ঈদের পর দোকানে আসলে কাগজপত্র দেখাব। অন্যরা তা জানে না’। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি গুদাম হচ্ছে সরকারি। এখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা নয়’।

মো. আলম বলেন, ‘আমি শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে ব্যবসা করি। আমার কোনো দোকান নেই। সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর চাল কিনি। ডকুমেন্ট রয়েছে’। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে শাহাব উদ্দিনের নাম আসলেও গুরুত্ব দেন না তিনি। আমার নামও আসার প্রয়োজন ছিল না। তারপরও এসবের কিছুই হবে না’।

এছাড়াও পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী ফারুক ট্রেডিংয়ের মো. ফারুক, শাহাবউদ্দিনের ব্যবসায়ী অংশীদার এয়াকুব ট্রেডার্সের এয়াকুব মুন্সি, এ কে ট্রেডার্সের বিভাস দত্ত ও শাহাব উদ্দিনের ছোট ভাই বাহার মিয়া (গ্রেপ্তারকৃত) চাল পাচারকারী চক্রে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, খাদ্য বিভাগ ও ব্যবসায়ী সূত্রে এসব কথা জানা যায়।

গেল বছরের এপ্রিলে পাহাড়তলী বাজার থেকে ২১ বস্তা সরকারি চালসহ উদ্ধার হয়েছিল মেসার্স ফারুক ট্রেডার্সের গুদাম থেকে। সরকারি ত্রাণের চালের ১৫শ খালি বস্তা ও ৯ হাজার চটের বস্তা পাওয়া যায়। সরকারি চালের বস্তা পাল্টিয়ে নুরজাহান ব্যান্ডের বস্তায় ভরে বাজারজাত করার সময় তা জব্দ করেছিল পুলিশ। খাদ্য গুদাম থেকে বার বার চাল ধরা পড়ার পরও অদৃশ্য কারণে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বাঘর-বোয়ালরা।

চাল পাচারের নেপথ্যে রয়েছে, পরিবহন ব্যবসায়ী খোকন কান্তি দাশ এবং মধ্যস্বত্বভোগী বা ডিও ব্যবসায়ী জনি ও সাইফুল। পাহাড়তলী চাল পাচারের ঘটনায় খোকন কান্তি দাশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মেসার্স সবুজ এন্ড ব্রাদার্সের মালিক। মামলায় সরকারি চাল আত্মসাৎ ও বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের হাতে জব্দ করা চালগুলোর পরিবহন ঠিকাদার ছিল সবুজ এন্ড ব্রাদার্স।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট