চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

হাঁসের খামারে শিমুলের ভাগ্য বদল

এফ. আই মানিক 

৯ মে, ২০২১ | ১:৩২ অপরাহ্ণ

সবে দেশটা স্বাধীন হয়েছে। দিনকাল তেমন ভালো না কাটলেও পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে স্বস্তির বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে দিন কাটছিল। একদিন হঠাৎ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। পরিবারের সবাই চিন্তাগ্রস্ত।

কথায় আছে, যার টাইফয়েড হয় তার কিছু না কিছু ক্ষতিও হয়। টাইফয়েড ক্ষতি করে বসে তার দুই পায়ের। কিছুটা অবশ হওয়ার মতো অবস্থা। এরপরও চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে পরিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেন। দিনকাল চলছিল ভালোই। ১৯৭৩ সালের দিকে পুনরায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে দুটো পা-ই বেঁকে গিয়ে প্রতিবন্ধী জীবন মেনে নিতে হলো। সংসারে নেমে এলো অমানিশার আঁধার। পিতার ৪০/৪২ বছরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আর যাওয়া হলো না।

সংসারে এক ধরনের বোঝা হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট। কেন সৃষ্টিকর্তা এমন অমানবিক হলেন! কেন এতো বড় শাস্তি দিলেন! কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। তার মুখে কথা আটকে যাচ্ছিল। বলছিলাম বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া আমুচিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের রক্ষিত বাড়ির শিমুল রক্ষিতের কথা। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নিয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল অকালে। বাবার ব্যবসায় দিন দিন লোকসানের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চলে আসতে হলো গ্রামে।

একদিন শিমুল রক্ষিতের বড় ছেলে রাজ রক্ষিত এইচএসসি পাশ করে সরকারি একটা চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে ঢাকায় গেলেন। ঢাকা থেকে ফেরার পর পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইলে ছেলে রাজু রক্ষিত মন খারাপ করে বললেন, ‘বাবা, আমাদের কপালে চাকরি সহজে জুটবে না। চলো আমরা একটা খামার করি। খামার করে ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করি।’ ছেলের কথা বাবা শিমুলের মনে ধরলো। কারণ ২০০৬ সাল থেকে নিজ গ্রামে এমন একটা কিছু করার পরিকল্পনা ছিলো শিমুল রক্ষিতের। তাই দেরি না করে আত্মীয় স্বজনের কাজ থেকে ধার করে, ব্যাংক থেকে কিছু ঋণ নিয়ে নিজের সাড়ে ৬ গণ্ডা জায়গায় ১ হাজার হাঁস নিয়ে গড়ে তুললেন ‘তাঁরা মা হাঁসের ফার্ম’।

২০২০ সালের জুন মাসে সর্বমোট ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে গড়ে তোলা তাঁরা মা হাঁসের ফার্ম নিয়ে প্রতিবন্ধী শিমুল স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। পাশাপাশি সমন্বিত পদ্ধতিতে ২ কানি আয়তনের পুকুরে করেছেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ। বর্তমানে হাজার দেড়েক হাঁস আর পুকুরের মাছ চাষ নিয়ে ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী শিমুল রক্ষিত। তাঁর খামারে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কর্মসংস্থান হয়েছে আরো দু’জন গরিব মানুষের। এখন তিনি প্রতিদিন আনুমানিক ৯ শ’ হাঁসের ডিম বিক্রি করেন। পুকুরের মাছগুলো বড় হয়ে বিক্রির উপযোগী হলে সেখান থেকেও লাভবান হবার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

কর্মচারীদের সাথে পঙ্গু দুই পা নিয়ে পুকুরে জাল দিয়ে ঘেরা দিতে দিতে শিমুল বললেন, ‘এখন আমার ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। দুই ছেলে রাজ রক্ষিত ও নিলয় রক্ষিত পড়ালেখা করে চাকরি না পেলেও এই খামার দিয়ে তাদের জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারবে। সেই সাথে খামারের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পেলে আমার খামারে আরো কয়েকজন গরিব লোকের কর্মসংস্থান হবে। একদিন প্রতিবন্ধী বলে যখন জীবনের প্রতি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, আজ সেই আমি খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরে গর্ববোধ করছি।’

তবে করোনাকালীন সময়ে ডিমের ব্যবসায় কিছুটা লোকসান হচ্ছে বলে জানান শিমুল রক্ষিত। খামারের ডিমগুলো তিনি সাধারণত চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার আর ফিরিঙ্গীবাজারে বিক্রি করে থাকেন। কিন্তু বর্তমান লকডাউনের কারণে নিজ এলাকা ও বোয়ালখালীর বিভিন্ন দোকানে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাই কিছুটা লোকসান হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার মন্দাভাব কেটে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এছাড়া হাঁসের খাদ্যের দামও চড়া বলে জানান তিনি। তার খামারে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকার খাদ্য লাগে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এলাকার সবার কাছে এখন ভাগ্য পরিবর্তনের রোল মডেল প্রতিবন্ধী শিমুল রক্ষিত।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট