চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বিশ্ব মা দিবস আজ

রন্ধনশালা সামলেও যারা রত্নগর্ভা

ইমাম হোসাইন রাজু 

৯ মে, ২০২১ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

সন্তানকে বড় করতে গিয়ে নিজেদের পরিচয় আড়ালেই চলে যায় আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়ের। নিজের ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনা সবকিছু ত্যাগ করেন শুধু সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার স্বপ্নে। এই প্রতিবেদনে এ রকমই চারজন গৃহিণী-মায়ের সাফল্যের গল্প শোনাব।

এই মায়েরা একইসাথে রত্নগর্ভা তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের জন্য কাজ করছেন এবং কেউ কেউ কোভিড মহামারীতে ছিলেন সম্মুখযোদ্ধাও (ফ্রন্টলাইনার)। মায়ের কষ্ট এবং অবদান জীবনের কোন পর্যায়েই যেন সন্তান ভুলে না যায়- এমন প্রত্যাশা সকল মায়ের।

আয়েশা বেগম চৌধুরী। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করা এই নারী নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সাতকানিয়ার আইনজীবী মোক্তার আহমেদ চৌধুরীর সাথে। সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে ভাল মানুষ করার প্রত্যয়ে প্রায় ষাট বছর আগে সাতকানিয়ার মফস্বল শহরে টিনের চালের একতলা ভাড়া বাড়িতে দীর্ঘযাত্রা শুরু আয়েশা বেগমের। দীর্ঘসময় ধরে প্রতিবছর মোকাবেলা করতে হয়েছে বন্যার মত ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতি। দীর্ঘ এ চলার পথে বহু ঘাত-প্রতিঘাত এলেও তিনি কখনো দমে যাননি।

সন্তানের মা হয়েও প্রত্যেককে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। তার ফলাফল হল তার সন্তানদের সাফল্য এবং দেশের জন্য তাদের অবদান। তাদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী। এই সময়ে যিনি সবার কাছেই পরিচিত কোভিড হিরো হিসেবে। দিনরাত চিকিৎসা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকা এ চিকিৎসকই হচ্ছেন দেশের প্রথম কোভিড টিকা গ্রহণকারী চিকিৎসক। পরিবারে আছেন  আরো তিনজন ফ্রন্টলাইনার। আরেক সন্তান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. রুকুন উদ্দিন চৌধুরী। যিনি এফিসিপিএস ও এমআরসিপি সম্পন্ন করে আছেন ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ নিউরোসার্জন হিসেবে।

ঢাকা মেডিকেলের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. ফরহাদউদ্দিন মাস্টার্স করেছেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং খুব অল্প বয়সেই এফসিপিএস সম্পন্ন করেন। আরেকজন ড. নঈমউদ্দিন হাছান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রকৌশলী ও ব্যাংকার হিসেবে রয়েছেন আরেক সন্তান জিয়াউদ্দিন হাছান। অন্য দুই সন্তান মঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন হাসান চৌধুরী জড়িত আছেন রাজনীতিতে এবং  সেবা করে যাচ্ছেন মানুষের। তার দুই কন্যা আইনজীবী ও একজন শিক্ষিকা। আয়েশা বেগম প্রত্যাশা করেন আগামী দিনের মায়েরা শুধুমাত্র তথাকথিত শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত না করে একজন ভাল মানুষ ও সুনাগরিক হয়ে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জোর দিবেন।

প্রতিযোগিতামুলক এই বিশ্বে বুয়েট ও আইবিএ থেকে স্নাতক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বহুজাতিক কোম্পানির কর্পোরেটে সন্তানদের অবস্থান, যেকোন মায়ের জন্য অনেকটা স্বপ্নের মত। কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন রওশন আরা (লিলি)। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এস এম কামাল উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা অনেকটা পথ একাই পাড়ি দিয়েছেন স্বামীর মৃত্যুর পর। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ফটিকছড়ি থানার রোসাংগিরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই নারীর শৈশব রোসাংগিরিতে অবস্থিত হালদা নদীর তীর ঘেঁষে বিশাল বাড়িতে কাটলেও কিছুদিন পরে তাদের যৌথ পরিবার থিতু হয় নগরীর দেওয়ানবাজারের নিজস্ব বাড়িতে। তিনি নিম্নমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন ডা. খাস্তগীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে। তার একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রিয়াদ আল কামাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ হতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) হতে এমবিএ সম্পন্ন করেন।

বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে বর্তমানে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। বড় মেয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. রোজান্না বিনতে কামাল বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজী বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। মেজ মেয়ে তাকমিনা কামাল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে ইরিনা রুবাইয়া কামাল একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে ডেপুটি ম্যনেজার হিসেবে কর্মরত। তাঁর ভাষায়, “আমার স্বামী   যেহেতু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, সেই স্বাধীন দেশে যেন আমার সন্তানরা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে এই বিষয়টাকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়েছি।’’

মৃত্যুর পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করে ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খালেদা চৌধুরী। নগরীর উত্তর কাট্টলীতে জন্মগ্রহণ করা এই নারীর বাঁশখালী থানার খানখাবাদ ইউনিয়নের কদম রসুল গ্রামের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এয়ার মোহাম্মদের সাথে বিবাহ হয়। বিয়ের মাত্র বিশ বছরের মাথায় চারজন কৈশোর উত্তীর্ণ সন্তানকে নিয়ে স্বামীকে হারান খালেদা চৌধুরী। কিন্তু  হেরে যাননি। একক প্রচেষ্টায় খালেদা চৌধুরী পুলিশ, জেলা প্রশাসক, চিকিৎসক এবং ব্যাংকার হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজ সন্তানদের।

বড় ছেলে হাসান ইকবাল চৌধুরী অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিলেটে কর্মরত আছেন। মেজ ছেলে রাশেদ ইকবাল চৌধুরী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসেবে কর্মরত আছেন সুনামঞ্জে। একমাত্র মেয়ে শাহিদা চৌধুরী দীনা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর অধ্যয়ন করছেন। ছোট ছেলে তৌহিদ ইকবাল চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এ কর্মরত আছেন। একা একা সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে কি লক্ষ্য ছিল- এ প্রসঙ্গে খালেদা চৌধুরী বলেন, “সন্তানরা যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে এবং তাদের পিতার মত দেশের কাজে লাগতে পারে সেটিকেই প্রাধ্যন্য দিয়েছিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের লেখাপড়ায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে সবসময় সচেষ্ট ছিলাম।’’

সিক্স ডক্টর’স ফ্যামিলি বলে অনেকেই মজা করেন জোবায়দা লুৎফুন্নাহার কাদেরীর পরিবারকে। স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূ ও জামাতা মিলে চারজন চিকিৎসক ও দুইজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী তার পরিবারে। বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারকে। আর গুরুত্ব দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা বিকাশে। নিয়মিত তারা অংশ নিতেন স্কাউট, রেডক্রিসেন্ট, গার্লগাইড, বিতর্ক, এথলেটিক্স ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে। আরও চেয়েছেন ছেলেমেয়েরা যেন দেশেই থাকে, বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু করে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এমএ মান্নানের স্ত্রী জোবায়দা আজীবন চেয়েছেন ছেলেমেয়েরা মানবিক মানুষ হোক। তার সেই স্বপ্ন সফল। বড় ছেলে গত এক বছর বিরামহীন ও আন্তরিকভাবে চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন কোভিডে গুরুতরভাবে জটিল সব রোগীদের চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ’তে। ডা. মো. মইনুল আহসান কর্মরত আছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে আইসিইউ’তে। তার বড় মেয়ে তায়েবা নাজমুন একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। কনিষ্ঠ সন্তান ড. আদনান মান্নান একজন গবেষক ও শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ হাল ও কার্টিন ইউনিভার্সিটি’তে এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার। জোবায়দা লুৎফুন্নাহারের দুই পুত্রবধূ চিকিৎসক। জামাতা বুয়েট থেকে পড়াশোনা করে চুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে আছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

জোবায়দা লুৎফুন্নাহার কাদেরীর শৈশব কেটেছে কালুরঘাটস্থ মোহরা এলাকায় কাদেরী বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া জোবায়দা কাদেরীর অনুপ্রেরণা তার বাবা নুরুল হুদা কাদেরী ও মা নুরুন্নাহার খানম। এখনকার মায়েদের জন্য জোবায়দা লুৎফুন্নাহার কাদেরী বলেন, “খুব সাদামাটাভাবে সন্তানদের বড় করতে হবে। তাহলেই তারা মোহমুক্ত থাকবে আর জীবনকে অনেক সরলভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।’’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট