চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অসচেতনতায় বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যু

ইমরান বিন ছবুর 

৪ মে, ২০২১ | ১২:২৬ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে শুরু হয়েছে বজ্রপাতের মৌসুম। দেশে প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাস পযন্ত প্রচুর বজ্রপাত হয়। তবে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে এপ্রিল ও মে মাসে। কোন কোন বছর জুন-জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। একই সাথে কোটি কোটি টাকার সম্পদও নষ্ট হচ্ছে।

গত শনিবার বজ্রপাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় তিনজন এবং রাঙামাটি জেলায় একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও গত ২৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জে দুই সহোদর নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, গত ছয় বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ৮৫১ জন নিহত ও ৩শ জন আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন, দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান নেটওয়ার্ক ফর ইনফরমেশন রেসপন্স এন্ড প্রিপিয়ারনেস এক্টিভিটিস অন ডিজেস্টার (নিরাপদ)। প্রতিষ্ঠানটি দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় দৈনিক থেকে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করেন বলে জানান, নিরাপদ’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হাসিনা আক্তার মিতা। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই মূলত বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে মনে করছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বজ্রপাতের বেশির ভাগ শিকারই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশের আকাশে সাধারণত মার্চ থেকে শুরু হয়ে মে মাস পর্যন্ত বজ্রমেঘ বেশি দেখা যায়। তবে কোন কোন সময়ে তা জুন-জুলাই পর্যন্ত দেখা যায়। বন্যা, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও সুযোগ থাকে। তবে বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতোই প্রাকৃতিক এবং অতি আকস্মিক একটি বিষয়। বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতা প্রয়োজন এবং প্রাণহানি কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ছয় বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা : গত ছয় বছরে বাংলাদেশে ৮৫১ জন নিহত এবং ৩শ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও, বিপুল পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ২০১৫ সালে ৪৬ জন নিহত এবং ৪৭ জন আহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১২১ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত, ২০১৭ সালে ৪৮ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত, ২০১৮ সালে ২৯০ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত, ২০১৯ সালে ১৮৪ জন নিহত এবং ৮৭ জন আহত এবং ২০২০ সালে ১৬২ নিহত এবং ৩০ জন আহতের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, গত ৩০ বছরে (১৯৯০ থেকে ২০২০) চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় মোট ৭৫ জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী।

মানুষ কখন সচেতন হবে : আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, বজ্র ঝড় শুরু হওয়ার সময় তিনটি ধাপ থাকে। প্রথম ধাপে বিদ্যুৎ চমকানি বা বজ্রপাত শুরু হয় না। প্রথমে মেঘ তৈরি হতে থাকে এবং সে সময় আকাশের অবস্থা একটু কালো মেঘের মতো তৈরি হয়। এরপর সামান্য বৃষ্টি ও হালকা বিদ্যুৎ চমকায়। সেই সময়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে। বাইরে থাকলে যখন দেখা যাবে আকাশ কালো হয়ে আসছে তখনি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড. ফাতিমা আক্তার বলেন, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত কালবৈশাখী এবং বজ্রপাত বেশি হয়। বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই এটা বন্ধ বা থামিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে এর থেকে প্রতিকারের জন্য আমরা কিছু ব্যবস্থা নিতে পারি। এই বজ্রপাত যেহেতু খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়, তাই এটা আগে থেকে বলা যায় না।
তিনি আরো বলেন, তবে বজ্রপাত নিয়ে আমরা গবেষণা শুরু করেছি। বজ্রপাতের কতক্ষণ আগে আমরা জানাতে পারবো, সে বিষয়ে কাজ চলছে। বজ্রপাতের পূর্বে যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করছি। এপ্রিল-মে মাসে আমাদের দেশে বোরো হয়। ক্ষেতে কাজ করতে গিয়েও অনেক কৃষক মারা যান। এছাড়াও ফসলের ক্ষতিও হয়।
বজ্রপাতের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় আসার দুই তিনদিন আগে থেকে সরকার প্রস্তুতি নেয়। ঘূর্ণিঝড় শেষ হলে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হয়। অন্যদিকে, প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বজ্রপাতে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সেভাবে আমাদের নজরে আসে না।
বজ্রপাত থেকে রক্ষায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ :

১. পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভালো। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনও দালানের নিচে আশ্রয় নেয়া যায়।
২. উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় এ সব জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে।
৩. জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর থাকতে হবে।
৪. ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলোর সংস্পর্শ আসলে হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে।
৫. টিভি-ফ্রিজ থেকে সাবধান। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ থাকলেও স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখতে হবে।
৬. বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করতে হবে। যদি প্রচ- বজ্রপাত ও বৃষ্টি শুরু হয় গাড়ি কোনো পাকা ছাউনির নিচে যেতে হবে। তবে এ সময় গাড়ির কাঁচে হাত দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
৭. বজ্রপাত অব্যাহত থাকলে রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। রাস্তায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া, কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়লে বিদুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
৮. বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বেরোতেই হয় পা ঢাকা জুতো পড়ে বের হতে হবে। এ ক্ষেত্রে রবারের গাম্বুট সব থেকে ভালো কাজ করবে।
৯. বজ্রপাতের সময় রাস্তায় চলাচলের সময় আশেপাশে খেয়াল রাখতে হবে। যে দিকে বাজ পড়ার প্রবণতা বেশি সে দিক বর্জন করতে হবে। কেউ আহত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
১০. ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে চোখ বন্ধ রাখতে হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। কারণ মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১১. বজ্রপাতের সময় নদী বা জলাশয় থেকে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে এবং জলাশয় বা জলাবদ্ধ স্থান থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কারণ পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী। নৌকায় অবস্থান করলে দ্রুত ছইয়ের নিচে অবস্থান নিতে হবে। নৌকায় ছই না থাকলে নিচু হয়ে পাটাতনে অবস্থান নিতে হবে।
১২. বাড়িকে নিরাপদ রাখতে বজ্রনিরোধক যন্ত্র লাগাতে হবে এবং সেই সঙ্গে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট