চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

জ্ঞানের আলো জ্বলছে ১১৯ বছর

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

২৩ এপ্রিল, ২০২১ | ১২:৩১ অপরাহ্ণ

কানুনগোপাড়া-শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল গ্রাম। জন্ম নিয়েছেন রত্নাগর্ভাসহ অনেক পুণ্যপুরুষ ও জ্ঞানী-গুণীর। সুখ্যাতি রয়েছে ভারতবর্ষসহ উপমহাদেশে। ঐতিহাসিক এই জনপদে ছুটে এসেছিলেন ভারতের দুই সাবেক রাষ্ট্রপতিও। এই গ্রামের ‘বান্ধব পাঠাগার’ বই পড়া আন্দোলন থেকে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১২৯ বছর ধরে বই পড়ার আন্দোলন ও সমাজ উন্নয়নে আলো ছড়াচ্ছে।

এখন ঘুরে আসি কানুনগোপাড়া গ্রামের বান্ধব পাঠাগারে। বোয়ালখালী উপজেলার পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ঘেরা ছায়া-সুবিনিড়, শান্ত পরিবেশ। বড় আকারের দুটি পুকুরের গা ঘেঁষেই গড়ে ওঠেছে ঐতিহাসিক এই বান্ধব পাঠাগার। পাঠাগার ও পুকুর দুটিকে আগলে রেখেছে বড় বড় গাছপালা। পাঠাগারটি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি টিনশেডের সেমিপাকা হল রুম। যার নামকরণ করা হয়েছে সুবিমল দত্ত সাংস্কৃতিক অডিটোরিয়াম। সুবিমল দত্ত হচ্ছেন স্বাধীন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি সচিব। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারতীয় প্রথম রাষ্ট্রদূত হন।

এই হলরুমে আড়াই শতাধিক লোক বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে এক সময় নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বন অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে সীমিত আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বন হয়। নাটক মঞ্চায়ন হয় না বলে জানান স্থানীয় চেয়ারম্যান কাজল দে। পাশে দোতলা ভবন হচ্ছে লাইব্রেরি। ওপর তলায় বড় বড় আলমারিতে সাজানো রয়েছে থরে থরে বই আর বই। পড়ারও সুব্যবস্থা রয়েছে। তবে বই ঘরে নিয়ে পড়ার অভ্যাস বেশি পাঠকদের।

আমুচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও পাঠাগার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি কাজল দে বলেন, ভারত সরকারের সাবেক অর্থ সচিব সুমিত বোস ছিলেন এই গ্রামের জামাই। ভারত সরকারের উপহার হিসেবে তিন দফায় প্রায় ৪৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেন। ২০১১ সাল থেকে এই টাকায় পাঠাগারের উন্নয়ন কাজ চলছে।

দেখা যায়, আলমিরাতে শত শত বই। রয়েছে দুর্লভ বইও। বিশেষ করে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে রয়েছে অনেক দুর্লভ বই। পাঠক কমে যাওয়া ও করোনায় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বইয়ের উপর ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। পাঠাগারে ১৫ শতাধিক বই রয়েছে।

১৯০২ সালে বান্ধব পাঠাগার (ফ্রেন্ডস লাইব্রেরি) যাত্রা শুরু হয়। মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কানুনগোপাড়া গ্রামের প্রাণপুরুষ রেবতী রমণ দত্ত। তখন ছিল স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল সময়। সমাজসেবা, তরুণ-যুবকদের মধ্যে বই পড়া, শরীরচর্চা, নৈতিক শিক্ষা ও আলোকিত যুব সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দান করেন স্থানীয় নিশি চন্দ্র সেন, কিশোরী মোহন দত্ত, শশী কুমার দত্ত, বঙ্গ দত্ত, কাশী মোহন দত্ত, দেবেন্দ্রলাল দত্ত, অটল বিহারী দত্ত, ফনিন্দ্র লাল দত্ত ও আরও কয়েকজন দানশীল ব্যক্তি। বান্ধব পাঠাগারে পাঠচর্চার পাশাপাশি শরীরচর্চা, সন্তরণ, লাঠিখেলা ও কুস্তিখেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতো।

এই পাঠাগার কালে কালে জন্ম দিয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী, ঋধ্য পুরুষের। স্বদেশি আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই পাঠাগার। পাঠাগারে শরীরচর্চা ছাড়াও বিপ্লবী নানা ধরনের বই ছিল। এসব বই পড়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন অনেক তরুণ। এই গ্রামের সন্তান বিপ্লবী লোকনাথ বলকে জালালাবাদ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতির গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন। কানুনগোপাড়া ও আশপাশের গ্রাম ধোরলা, সারোয়াতলী গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।

রেবতী রমণ দত্ত ছাড়াও এই গ্রামের আলোকবর্তিকা ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী, মোক্ষদা রঞ্জন কানুনগো, ড. বিভূতি ভূষণ কানুনগোসহ আর কয়েকজন যুবক মিলে এই সংগঠন গড়ে তোলেন। স্বদেশী আন্দোলনে এই সংগঠন গোপনে আন্দোলনের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে আসে। ফলে ব্রিটিশ সরকার এই সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীতে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘কানুনগোপাড়া বান্ধব পাঠাগার’। পাঠাগারের আড়ালে গ্রামের নির্জন এলাকা ও পাশের করলডেঙ্গা পাহাড়ে চলত বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ। গড়ে উঠে বিপ্লবী দল। এই দলের অনেক বিপ্লবী কারাবরণও করেছেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টার দা সূর্যসেন কয়েকবার এই কানুনগোপাড়া গ্রাম ও গোপন আস্তানা পরিদর্শন করেছিলেন।

এই এলাকার মতি কানুনগো ও হরিগোপাল বল জালালাবাদ যুদ্ধে শহীন হন। সুখময় কানুনগো সহিংস প্রশিক্ষণে শহীদ হন। লোকনাথ বল, সুশীল দেসহ কয়েকজন অস্ত্রাগার আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছাড়াও স্বাধীনতা সংগ্রামেও গৌবরোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল এই গ্রামের। তাছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, নাটক-চলচিত্র নির্মাণে এই গ্রামের খ্যাতি ছিল উপমহাদেশে।

পাঠাগারের সহ-সভাপতি অলক সর্ববিদ্যা বলেন, পাঠাগারের চারপাশে, পুকুর পাড়ে, বিলে, সড়কের পাশে বই-পত্রিকা পড়া, দাবা, ক্যারম, ভলিবল খেলা আর গান, নাটকের রিহার্সাল করা-এসব ছিল সোনালি অতীত। এখন সব মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আকাশ সংস্কৃতির দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে গ্রাম-বাংলার প্রাণের সংস্কৃতি।

পাঠাগার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার দত্ত বলেন, পাঠাগার নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। তারপরও বান্ধব পাঠাগার তার গৌরব ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

১৯৪৫ সালে বান্ধব পাঠাগারের মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৮ সালের বন্যায় তা বিধ্বস্ত হয়। ’৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয়বার বিধ্বস্ত হয় পাঠাগার। এছাড়াও ‘৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাঠাগারের বইপুস্তক পুড়ে দেওয়া হয়। বার বার বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়েছে এই পাঠাগার। তারপরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১১৯ বছর ধরে বই পড়া ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের দ্যুতি ছড়াচ্ছে গৌবরোজ্জ্বল বান্ধব পাঠাগার।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট