চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চাহিদা নেই, হতাশ মৃৎশিল্পীরা

অনুপম কুমার অভি, বাঁশখালী

১৪ এপ্রিল, ২০২১ | ১:৪৩ অপরাহ্ণ

ষাটের দশকেও ঘরে ঘরে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার ছিল। বৈশাখী মেলা ও গ্রামীণ বিভিন্ন উৎসবে এসব তৈজসপত্র ও মাটির খেলনার বিকিকিনি চলত। কিন্তু এলুমিনিয়াম, প্লাস্টিক যুগে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা শূন্যের কোঠায়। মৃৎশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে কিছু কিছু মাটির সামগ্রীর এখনো প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে বৈশাখী মেলায় এসব পণ্য বিক্রি করেন মৃতশিল্পীরা। করোনার কারণে গত বছর বৈশাখী উৎসব হয়নি।

এবারো হচ্ছে না। বাঁশখালী উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন চাম্বল, জলদী, কালীপুর ও সাধনপুরের দক্ষিণ ও মধ্যম সাধনপুর রুদ্র পাড়ার ৮শ পরিবারের প্রায় ৩ হাজার নারী পুরুষ মাটির তৈজসপত্র তৈরি কাজে জড়িত ছিলেন। বর্তমান সময়ে মাটির তৈরি বাসন কোসন, ডেকচি, হাঁড়ি, কলসি, গ্লাস, ফুলের টব ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের খেলনা ইত্যাদির চাহিদা ব্যাপক হারে না থাকায় কুমার পাড়ায় তৈজসপত্র তৈরি ও পোড়ানোর দৃশ্য আগের মত চোখে পড়ে না। একশ বছরের পুরনো গ্রাম কুমোরপাড়ার কুমারদের বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ।

এলাকাবাসী জানায়, ক্ষেত্রলাল রুদ্র, আশু রুদ্র, মৃদুল চন্দ্র রুদ্র, বিমল রুদ্র বাপ-দাদার পেশায় জড়িত রয়েছেন। মাটি দিয়ে হাঁড়ি, পাতিল বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে পাইকারি ব্যবসায়িদের কাছে সামান্য দামে বিক্রি করেন। এইভাবে তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। পূর্ব পুরুষের পেশা আকড়ে ধরে জীবন চালাচ্ছেন ক্ষেত্র লাল রুদ্র ও মৃদুল চন্দ্র রুদ্র। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়েও ক্ষেত্র লাল রুদ্র তার সন্তানকে লেখাপড়া ও চাকরির জন্য সহায়তা করে যাচ্ছেন।

তিনি জানান, চট্টগ্রামের বৈশাখী মেলায় এক সময় নদী পথে নৌ-সাম্পান নিয়ে ব্যাপারিরা মাটির তৈরি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করে নিতেন। এরা চাহিদা অনুসারে টাকাও দিতেন। আধুনিক যুগে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা এখন গ্রামের মানুষের কাছেও তেমন নেই। চাহিদা কম থাকা সত্ত্বেও বাপ দাদার স্মৃতি হিসেবে বাধ্য হয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করছি। প্লাস্টিক ও এলমুনিয়ামের তৈরি রকমারি পণ্যের কারণে মানুষ দিন দিন মাটির  তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে।

সাধনপুর গ্রামের রুদ্রপাড়ার লোকজনদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, একসময় বিভিন্ন খাল-বিল থেকে মাটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে  তৈজসপত্র তৈরি করা হতো। বর্তমানে সেসব খাল-বিল থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করতে তাদের ভূমির মালিকদের ৪ শতক জমি ১ বছরের জন্য ৬-৭ হাজার টাকা লাগিয়ত দিতে হয়। টাকা দিয়ে মাটি কিনে এনেও পেশা চালাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া ১ বোঝা খড় ক্রয় করতে হয় ৫শত টাকায়। ১ বোঝা কাঠ ক্রয় করতে হয় ৩শত টাকায়। ইট ভাটার মত তৈজসপত্রগুলো পোড়ানো হয়।

মৃৎশিল্পী মৃদুল রুদ্র ও বিমল রুদ্র জানালেন, ২০০০ সালেও এখানকার কুমাররা মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বাজারজাত করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সুখে জীবনযাপন করতাম। এখন শুধু গবাদিপশুর পানি পানের চাড়ি, দইয়ের হাঁড়ি, গায়ে হলুদের ছোট কলসি, পূজার বাতি আর বিভিন্ন মেলা উৎসবে শিশুদের খেলনা ছাড়া আর কোনো জিনিসই চলে না। এ দিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর।

সরকারিভাবে ব্যাংক ঋণ না থাকায় বেসরকারি সংস্থা থেকে অধিক মুনাফায় ঋণ সংগ্রহ করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এই জন্য এই পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অনেক কুমার।  বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদী রুদ্র পাড়ার রাখাল রুদ্র জানান, মাটির তৈরি জিনিসপত্র বেচা-বিক্রি করতে বাজারে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। পাইকারি ব্যবসায়িরা বাড়িতে এসে মাটির ব্যাংক, কলসি, পাতিল, হাঁড়ি, ফুলদানি, টব, পূজার বাতি  ও খেলনা সামগ্রীর তৈজসপত্রগুলো নিয়ে যায়।

কালীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এডভোকেট আ.ন.ম শাহাদত আলম বলেন, এক সময় কালীপুর রুদ্রপাড়ার কুমারদের তৈরি তৈজসপত্রের চট্টগ্রামব্যাপী প্রচুর চাহিদা ছিল। বৈশাখী মেলায়ও বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হতেন এখানকার কুমার পরিবারের লোকজন। চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন কালীপুরের মৃৎশিল্পীরা পেশা পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট