চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনামুক্ত আলোকজ্জ্বল দিনের প্রত্যাশা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১৩ এপ্রিল, ২০২১ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

চৈত্র সংক্রান্তি আজ। ঋতুরাজ বসন্তের শেষ দিন, চৈত্রেরও শেষ। বাংলা পঞ্জিকায় আজ বঙ্গাব্দ ১৪২৭-এর শেষ সূর্যোদয়। আজকের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়েই বিদায় নেবে আরও একটি বাংলা বছর। অতীতের সব জরাজীর্ণ আর মলিনতাকে বিদায় জানাবে বাঙালি। প্রত্যাশা থাকবে, করোনা মহামারীমুক্ত সুন্দর-আলোকজ্জ্বল দিনের।

চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার হাজারো বছরের ঐতিহ্য। আয়োজন থাকতো লোকজ সংস্কৃতির নানা আয়োজন, গ্রামীণ মেলার। এবার করোনায় থাকছে না চৈত্র সংক্রান্তির কোনো আয়োজন। ঘরে বসেই পূজা-পার্বণ ও রীতি-নীতি মেনেই উদযাপন করা হবে দিনটি। গেল বছরও চৈত্র সংক্রান্তি ঘরের চার দেয়ালে বন্দি ছিল। করোনাভাইরাস কেড়ে নিল বাংলা পঞ্জিকার আরও একটি বছর। তবে এবার নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকবে একটি নতুন স্বপ্নের। মুক্ত পৃথিবীর।

রূপসী কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন, ‘অতীত নিশি গেছে চলে/চিরবিদায় বার্তা বলে/কোন আঁধারের গভীর তলে/রেখে স্মৃতিলেখা/এসো এসো ওগো নবীন/চলে গেছে জীর্ণ মলিন-/আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন/মুক্ত সীমারেখা।’ করোনা সংক্রমণকালে কবির কথাগুলো আজ মনের গহীনে ভেসে উঠবে বাঙালির মনে-প্রাণে। তবে বাংলা বছর বিদায়ের দিন চিরাচরিত নিয়মে চৈত্র সংক্রান্তি বাঙালির জীবন ও লোকাচারে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পুরনোকে বিদায় জানিয়ে কাল সকালেই আসবে ১লা বৈশাখের নতুন সূর্য। নতুন ভোর, নতুন আলো। নতুন প্রত্যাশা, করোনা মহামারী ও কঠোর বিধি-বিধান যুক্ত শৃঙ্খলমুক্ত সোনালি দিন। হাসি-খুশিতে আলোকোজ্জ্বল ভরা জীবন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র সংক্রান্তিকে পূণ্য দিন বলে মনে করে থাকেন। আচার অনুযায়ী এ দিনে বিদায় উৎসব পালন করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। দোকানপাট ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের যত সব জঞ্জাল, অশুচিতাকে বিদূরিত করা হয়। কারণ পরদিনই খোলা হবে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা ‘হালখাতা’। ধূপ ধূনোর সুগন্ধি ভারি করে রাখবে ঘরের পরিবেশ। তাছাড়া অভ্যাগত এলেই গোলাপ পানি ছিটিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে। বছরের প্রথম দিনের শুভক্ষণে খরিদ্দারদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তোলার রেওয়াজ হাজারো বছরের ঐহিত্য। পুরনো রেওয়াজ। মূলত আজকের দিন থেকেই হালখাতা নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশ ঘুচিয়ে ফেলে ক্রেতার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরিতে চলে মিষ্টিমুখ।

দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড় বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে চলছে বিশেষ আয়োজন, লাল মলাটের হালখাতা। শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা। তবে, এবার চলছে করোনাকাল। মহামারীর কারণে সরকার অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। ইচ্ছে করলেও এবার জৌলুসপূর্ণ পরিবেশে চৈত্র সংক্রান্তি বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সুযোগ নেই। তারপরও সীমিত পরিসরে শত বছরের ঐতিহ্য-রেওয়াজ পালন করবেন ব্যবসায়ীরা। ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে মেলার আয়োজন হতো। বাংলার সেই চিরায়ত মেলা গ্রাম ছাপিয়ে এখন শহুরে জনপদে ঠাঁই করে নিয়েছে। মেলা, গান, বাজনা ও যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে ভরপুর থাকতো লোকজ সংস্কৃতির আবহ। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব ও মেলা ছিল সর্বজনীন মিলনমেলা। এসব মেলায় মিলত গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে আধুনিককালের তৈজষপত্রও। চৈত্র সংক্রান্তি মেলা থেকে গৃহসজ্জা ও জীবনযাপনের নানা পসরা কিনতেন লোকজন। মেলায় থাকতো মন্ডা, মিঠাই ও খাবারের নানা আয়োজন। এবার মহামারীর কারণে এই ধরনের কোনো আয়োজন নেই, কী শহর-কী গ্রামে। করোনা স্থবির করে দিয়েছে আবহমান বাংলার চৈত্র সংক্রান্তির সেই আনন্দমুখর পরিবেশ।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, বাংলা মাসের শেষ দিনে শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়।  স্নান, দান, ব্রত, উপবাস-প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়। এই দিনে আমিষ নিষিদ্ধ। নিরামিষ শাকসব্জির সঙ্গে এদিন সাত তিতে রান্না করা হয়। ভাজা হয় বারো বা ততোধিক শাক।

পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুনকে বরণ করে নিতে রীতি মতো পূজা-অর্চনা ও ঘরোয়া আয়োজনে সীমাবদ্ধ থাকবে। অতীতের সব গ্লানি, ব্যর্থতা, রোগ-শোক, বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির প্রত্যাশা থাকবে সবার মনে। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চৈত্র সংক্রান্তিতে কোনো আয়োজন থাকছে না। অনেকটা ঘরে বসেই পালন করা হবে চৈত্র সংক্রান্তি। তারপরও প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ, শান্তি ও করোনামুক্ত উজ্জ্বল দিন।

কবিগুরুর সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আজ আমরা গেয়ে উঠবো ‘বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এল সমাপন/চৈত্র অবসান/গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের/সর্বশেষ গান।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট