চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

কর্ণফুলীতে নির্বিচারে চিংড়ি পোনা আহরণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১১ এপ্রিল, ২০২১ | ১২:১০ অপরাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে ঠেলাজাল ব্যবহারে নির্বিচারে চলছে চিংড়ি পোনা আহরণ। নদীর চাক্তাই থেকে শুরু করে রাঙ্গুনীয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে অবাধে পোনা আহরণ করা হচ্ছে।

সমীক্ষা বলছে, একটি চিংড়ি পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য প্রজাতির শতাধিক পোনা নষ্ট হচ্ছে। এতে মৎস্য প্রজনন ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান গবেষকেরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর নগরীর চাক্তাই-বাকলিয়া অংশ থেকে শুরু করে পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবাধে চিংড়ি পোনা আহরণ করা হচ্ছে। শত শত পোনা সংগ্রহকারী মশারি জালে তৈরি ঠেলাজাল দিয়ে পোনা সংগ্রহ করছেন।

কর্ণফুলী সেতু (শাহ আমানত সেতু) সংলগ্ন বাকলিয়া, ক্ষেতচর এলাকায় দেখা যায়, ছেলে-বুড়ো, মহিলা মিলে অসংখ্য লোক পোনা সংগ্রহ করছেন। এরমধ্যে শিশুরাও ঝুঁকি নিয়ে পোনা সংগ্রহ করছে। এছাড়াও পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও এবং বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদ-ী, কধুরখীল ও চরণদ্বীপ এলাকায় রাত-দিন সমানতালে পোনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। রাঙ্গুনীয়া উপজেলার বেতাগী অংশ পর্যন্ত পোনা আহরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও কর্ণফুলীর শাখা খাল রাঙ্গুনীয়ার কাউখালী খালেও প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।

পোনা সংগ্রহকারীরা জানান, প্রতিটি পোনা এক টাকা ৮০ পয়সা থেকে দুই টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে বেশি পরিমাণ পোনা পাওয়া যাচ্ছে বলে দাম কমে গেছে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় এলাকা থেকে পোনা সংগ্রহ করা হয়। মাছের প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ দ-নীয় অপরাধ। আইনে অবৈধ পোনা আহরণকারীদের এক-দুই বছরের কারাদ- ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা বিধান রয়েছে।

মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই কর্ণফুলীতে চিরুনী অভিযান শুরু হবে।’ তিনি বলেন, গত সপ্তাহে দোহাজারী থেকে প্রায় দুই লাখ পোনা জব্দ করা হয়েছে। পরে পোনাগুলো সাঙ্গু নদীতে অবমুক্ত করা হয়।’

মৎস্য বিভাগ জানায়, চিংড়ি পোনা আহরণে পুলিশ ও রাজনৈতিক পরিচয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। পোনা আহরণ ও পাচারবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে অনেক সময় বিপাকে পড়তে হয়।

গবেষকরা জানায়, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সাগরে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করায় ইলিশ উৎপাদনে বড় সাফল্য এসেছে। একইভাবে কর্ণফুলীতেও প্রজনন মৌসুমে চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ করা গেলে মৎস্য প্রজননে সহায়ক হবে। এতে কর্ণফুলী নদীতে মাছ উৎপাদনে বড় ভূমিকার রাখবে।

পোনা সংগ্রহকারীরা বলেন, অন্যান্য বছর বৈশাখ থেকে পোনা সংগ্রহ শুরু হয়। বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে পোনা ছাড়ে মা চিংড়ি। কিন্তু এবার অসময়ে পোনা পাওয়া যাচ্ছে। বৈশাখের আগেই রেণু ছেড়েছে মা চিংড়ি। ভাদ্র মাস পর্যন্ত পোনা সংগ্রহ করা হয়। তবে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে পোনা বেশি পাওয়া যায়। জোয়ার-ভাটায় দিনে দু’বার চিংড়ি রেণু ধরা হয়।

পোনা সংগ্রহকারীরা জানান, আহরিত পোনা সাতক্ষ্মীরা, খুলনা বাগেরহাট, ফেনী ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলার চিংড়ি হ্যাচারিতে সরবরাহ করা হয়। এনিয়ে গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগী ও পাচারকারী সি-িকেট।

দেখা যায়, ঠেলাজাল দিয়ে আহরিত পোনা থেকে শুধু গলদা রেণু বেচে নিয়ে অন্যান্য প্রজাতির পোনাগুলো ফেলে দেওয়া হয়। নদী তীরে ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে পড়ে থাকা পোনাগুলো কাক ও অন্য পাখিরা গিলে খাচ্ছে। একটি চিংড়ি রেণু সংগ্রহ করতে অন্য প্রজাতির শত শত পোনা নষ্ট করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া চিংড়ি পোনা আহরণের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, চিংড়ি পোনা আহরণ করতে গিয়ে নদীর অন্যান্য প্রজাতির শতাধিক পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে পোনা আহরণ করা হলে নদী একদিন জীব-বৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়বে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের দাবি করছি।

চিংড়ি পোনা ধরা ও পাচার নিষিদ্ধ হলেও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ চিংড়ি পোনা অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে অন্য জেলায়। কর্ণফুলী ও সাগর থেকে সংগ্রহকৃত পোনা নগরীর অলংকার মোড়ে এনে ড্রাম ভর্তি করা হয়। প্রতিড্রামে প্রায় ১০ হাজার পোনা সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে খুলনা, সাতক্ষীরাসহ হ্যাচারি প্রধান বিভিন্ন জেলায় পাচার করা হয়। চেয়ার কোচের ভেতরে ও ছাদে করে নেওয়া হয়। ড্রাম ভর্তি করে পাচার করা হয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট