চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

তীব্র খরায় বিপন্ন ১৭ চা বাগান

নিজাম উদ্দিন লাভলু, রামগড়

৭ এপ্রিল, ২০২১ | ২:২৪ অপরাহ্ণ

গত ৬ মাসে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অনাবৃষ্টিতে তীব্র খরায় জ্বলে মরে যাচ্ছে ফটিকছড়ি উপজেলার ১৭টি ছোট-বড় বাগানের চা গাছ। গাছে নতুন কুঁড়ি বা পাতা গজানো দূরে থাক,  খরার তীব্রতায় গাছের পুরনো পাতাগুলোও শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। সবুজ বাগানগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাগানগুলোর নতুন প্লাান্টেশনের চারাগাছ (ইয়ং টি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত বছরের জানুয়ারি

হতে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ফটিকছড়িতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, এক দশমিক ৬৯ মিলিমিটার। অথচ এ বছর এখনও বৃষ্টির  ছিঁটেফোঁটারও দেখা মেলেনি। ফলে নিরুপায় বাগানের মালিকরা আকাশের দিকে চেয়ে আছেন বৃষ্টির আশায়। সংশ্লিষ্টদের আশংকা, খরা পরিস্থিতি এভাবে আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার চায়ের উৎপাদনে চরম ধস নামবে। এছাড়া বাগানগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ শ্রীমঙ্গলে মার্চ মাসে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৩১ মিলিমিটার। আগাম বৃষ্টির কারণে ঐ অঞ্চলে চায়ের বাম্পার উৎপানের আশা করছেন  সংশ্লিষ্টরা।

ফটিকছড়ি উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৭টি চা বাগানের মধ্যে  হাতেগোনা কয়েকটি বাগানে রয়েছে নিজস্ব সেচ ব্যবস্থা। এগুলোর মধ্যে হালদা ভ্যালী বাগান শতভাগ সেচ সুবিধার আওতায় রয়েছে। এ বাগানে স্থাপিত ভূগর্ভস্থ পাইপ লাইনের মাধ্যমে পুরো প্লান্টেশনে সেচের ব্যবস্থা করা  হয়েছে। স্প্রিংকলের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে পুরো খরা মৌসুম মোকাবেলা করেন বাগান কর্তৃপক্ষ। ফলে খুব কমই ক্ষতির সম্মুখিন হয় বাগানটি। কিন্তু  অত্যন্ত ব্যয়বহুল  হওয়ায় এ ধরনের ব্যবস্থা অন্য বাগানগুলোতে নেই। বড় বাগানগুলোতে সেচের ব্যবস্থা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত।

জানা যায়, প্রচণ্ড খরায় বাগানের জলাশয়ও শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পাম্পের মাধ্যমেও পানি তোলা যাচ্ছে না।  ফলে কোনো কোনো বাগানে ব্যবস্থা থাকলেও পানির অভাবে সেচ দিতে পারছে না। মাঝারি এবং রুগ্ন ও দুর্বল শ্রেণির বাগানগুলোর অবস্থা  খুবই খারাপ। রুগ্ন বাগানের  মধ্যে মোহাম্মদ নগর, আধারমানিক, নাছেহা, দাঁতমারা এবং মাঝারি বাগানের মধ্যে পঞ্চবটি, মা জান, এলাহি নূর প্রভৃতি বাগান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রথম শ্রেণির বাগানগুলোর মধ্যে কৈয়াছড়া, কর্ণফুলী, উদালিয়া, নেপচুন, রামগড়, বারোমাসিয়া, রাঙ্গাপানি, নিউ দাঁতমারা বাগানে সেচ ব্যবস্থা থাকলেও তা সীমিত পরিসরে। ফলে খরায় এ বাগানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো কোনো বাগানে শ্রমিকরা কলসি, বালতি ইত্যাদির মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে চা গাছ  বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। গত নভেম্বর মাস হতে  অদ্যাবধি বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটাও পড়েনি এ অঞ্চলে। দিনে প্রচ- রোদে তাপমাত্রা ৩৭-৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকছে। এ অবস্থায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় মাটি শুকিয়ে যেন ইট হয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ খরায় সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নতুন প্লান্টেশনে রোপন করা চারা গাছ (ইয়ং টি) এবং বাগানের নার্সারির চারা। এছাড়া ক্লোন গাছগুলোও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ এ গাছগুলোর শিকড় নিচের দিকে বেশিদূর যায় না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। বাগানগুলোতে অনেকটা হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। মালিক-শ্রমিক সকলেই আকাশের দিকে চেয়ে আছেন বৃষ্টির আশায়। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে অধিকাংশ বাগানের গাছ মরে যাবে। বাগানগুলো দুর্বিপাকে পড়বে। ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হবে সবগুলো বাগান। তিনি আরও  বলেন, কোনো কোনো বাগানে সেচের মাধ্যমে গাছ বাঁচাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি আর কৃত্রিম সেচের মধ্যে অনেক তফাৎ। বৃষ্টির সময় আবহাওয়া শীতল থাকে। বর্তমান অনাবৃষ্টিতে কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থায় যে পানি দেয়া হয়, তার অনেকটা বাস্প হয়ে উবে যায়। এভাবে খরা অব্যাহত থাকলে রোগবালাইও দেখা দিতে পারে বাগানে।

রামগড় চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন বলেন, গত বছর  জানুয়ারি হতে মার্চ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এক দশমিক ৬৯ মিলিমিটার।  কিন্তু এ বছর  ৬ এপ্রিল  পর্যন্ত ছিঁটেফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। তিনি বলেন, রামগড় বাগানে ভূগর্ভস্থ সেচ লাইন থাকলেও জলাশয়ের পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। এছাড়া খরার তীব্রতা যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখন উৎপাদনের চেয়ে বাগানের গাছগুলো বাঁচানোর  লড়াই করা হচ্ছে। ব্র্যাকের মালিকাধীন কর্ণফুলী চা বাগানের ডিজিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ৬ মাসের অধিক সময় ধরে চলা অনাবৃষ্টি এবং তীব্র খরায় বাগানগুলোর প্রায় ২৫ ভাগ ইয়ং টি গাছ রোদে শুকিয়ে মরে গেছে। আগামী ৭-৮ দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত হলে হয়তো জুন-জুলাইয়ে স্বল্প পরিমাণে উৎপাদনে যেতে পারবে বাগানগুলো। তিনি আরও বলেন, শ্রীমঙ্গলে এবার পর্যাপ্ত পরিমাণ আগাম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ওখানকার বাগানগুলোতে দ্রুত কুঁড়ি ও পাতা গজিয়েছে। ফলে তারা আমাদের আগেই  উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে। এ অবস্থায় এবার চা উৎপাদনে চট্টগ্রাম অঞ্চল অনেক পিছিয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে। নেপচুন বাগানের জি এম কাজী ইরফান উল্লাহ বলেন, অনাবৃষ্টির কারণে শুধু উৎপাদন হ্রাস পাবে তা নয়, চায়ের গুণগত মানও ক্ষুণ্ন হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট