চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সৌমিত্র চক্রবর্তী

ঘোর সংকটে জাহাজ ভাঙাশিল্প

নিজস্ব সংবাদদাতা, সীতাকুণ্ড

৩ এপ্রিল, ২০২১ | ১২:১২ অপরাহ্ণ

সীতাকুণ্ডে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রতিবছর ২৫-৩০ লাখ টন লোহার যোগান ও প্রায় ১২’শ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। এ ছাড়া এ শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ হাজার মানুষের। পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ এর উপর নির্ভরশীল।

কিন্তু  দেশি-বিদেশি নানান ষড়যন্ত্র ও সরকারি কিছু দপ্তরের অসহযোগিতার কারণে দারুন সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি এখন ঘোর সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে অল্প সময়েই জাহাজ ভাঙা শিল্প সম্পূর্ণরূপে ধংস হয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন ৬০ এর দশকে। সে সময় প্রলংয়করী এক ঘূর্ণিঝড়ে একটি ‘কুইন আলপিন’ নামক একটি জাহাজ উপজেলার ফৌজদারহাট সাগর উপকূলে এসে আটকে যায়। পরে জাহাজটির মালিক পক্ষ অনেক চেষ্টা করেও এটি সচল করতে না পারায় স্ক্র্যাপ হিসেবে এটি ভেঙে  ফেলেন। এটি ভাঙার পর প্রচুর লাভ দেখতে পেয়ে পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ‘চিটাগাং স্টিল হাউস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে তা বিভাজন করে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটিই সীতাকুণ্ড জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রথম শিপব্রেকিং বলে ধরা হয়। মূলত এর পর থেকেই শিল্পপতিরা শিপব্রেকিং এর দিকে ঝুঁকতে থাকেন। ৮০ এর দশক ছিলো এ শিল্পের জন্য স্বর্ণযুগ। সে সেময় ফৌজদারহাট থেকে বারআউলিয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কি.মি. এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প। ইয়ার্ড সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ৫০টির অধিকে পরিণত হয়। এ সময় দেশের নির্মাণ শিল্পের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান রড তৈরির জন্য একমাত্র কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহার প্রধান উৎসে পরিণত হয় এ খাত। ফলে এটিকে ভাসমান লৌহ খনি উপাধি দেওয়া হয়।

২০০৭ এর দিকে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ শিল্প আরো ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে কুমিরা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং ইয়ার্ড সংখ্যা দাড়ায় ১৫৩টিতে। এ সময় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে সীতাকুণ্ড জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিস্তারের কথা। ফলে এর উপর কুদৃষ্টি পড়ে আন্তর্জাতিক মহলের। শুরু হয় নানামুখী ষড়যন্ত্র। এর সাথে যুক্ত হয় দেশিয় কিছু চক্র। ফলে ঘরে বাইরে শত্রুদের অপপ্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। তার উপর সরকারি কিছু কিছু দপ্তর এ শিল্পের তুচ্ছ কোন দুর্ঘটনা বা ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বারবার মোটা অংকের অর্থ পেতে মালিকদের চরম হয়রানি শুরু করেন। এসব কারণে হতাশ হতে থাকেন মালিকরা। যার ফলে ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো এ শিল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। আর এর ফলে ১৫৩টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গিয়ে বর্তমানে এখানে চলমান ইয়ার্ড রয়েছে মাত্র ৩৫টির মত। মাত্র ২২ জন মালিকের মালিকাধীন এ ইয়ার্ডগুলোর মধ্যেও অনেকগুলো এখন ঋণের জালে জর্জরিত। ফলে এ শিল্পের ভবিষ্যত ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না খোদ শিল্প উদ্যোক্তারাও।

এসব বিষয়ে শিপব্রেকার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, নানান চক্রান্তে অধিকাংশ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ। চালু মাত্র ৩৫টির মত ইয়ার্ড।  এ শিল্প দেশের লৌহ চাহিদার ৭০ শতাংশই পূরণ করছে। আমরা সরকারকে প্রতিবছর প্রায় ১২’শ কোটি টাকা রাজস্ব দিচ্ছি। কিন্তু পক্ষান্তরে সহযোগিতা পাচ্ছি না অনেক ক্ষেত্রেই। তিনি বলেন, আমাদের মালিকরা জাহাজ আনতে গিয়ে আগাম কর দেন। এই কর পরে ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা ফেরত না  দেওয়ায় এক হাজার কোটি টাকার মত কর গত ২ বছর ধরে আটকে গেছে। এতে মালিকরা পুঁজি শূন্য হয়ে পড়ছেন।

এ শিল্পটিতে সবার সহযোগিতা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন আরেফিন এন্টার প্রাইজ শিপব্রেকিং এর স্বত্বাধিকারী শিপব্রেকিং এসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমানে এ শিল্পকে অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই বলে কি কোনদিন বাস চলাচল বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন কেউ ? কিন্তু শিপইয়ার্ডে দুর্ঘটনা ঘটলেই ইয়ার্ড বন্ধ করে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পুনরায় চালু করা। এছাড়া তুচ্ছ বিষয়েও শিপইয়ার্ডগুলোতে নিয়মিত জরিমানা, মামলা দিয়ে দিয়ে এগুলো এখন একেবারেই ধংসের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের কার্য নির্বাহী সদস্য কে.আর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসাইন টিংকু বলেন এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকার যেমন বার্ষিক ১২শ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে তেমনি দেশে স্ক্র্যাপ লোহ সংকট সৃষ্টি হয়ে রডের দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। নির্মাণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেড় লক্ষাধিক মানুষ বেকার হয়ে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হবে।  দেশে লৌহার যোগান অব্যাহত রেখে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এ শিল্পটিকে রক্ষায় সরকার ও ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রিমিয়াম ট্রেড কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী নুরুন্নবী মানিক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট