চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক

মোছলেম উদ্দিন আহমদ

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৫:৫১ অপরাহ্ণ

বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। দুর্ভাগ্য জাতির, এ মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার ব্যাপক ষড়যন্ত্র হয়েছে এদেশে। একদিন বাঙালিরা যুদ্ধ করতে পারেনা বলে অপবাদ ছিল, পাকিস্তানিরাসহ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের এ জন্য বিভিন্ন রূপে তিরস্কৃত করত। কিন্তু ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে বাঙালিরা বীরের জাতি। পাকিস্তানি শাসককদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি তথা এদেশের জনগণ।
এ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালির জীবনদান ও দুইলাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কোটি কোটিবাঙালি ঘর-বাড়িও সম্পদ হারিয়েছে। ধ্বংস হয়েছিল দেশের অবকাঠামো। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোন সেনা অভ্যুত্থান ছিলনা। জাতীয়তাবাদী চেতনায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ মহান মুক্তিযুদ্ধ কোন ধর্মের যুদ্ধও ছিলনা, ধর্মীয় বিরোধের জন্য এ যুদ্ধ হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণা ও আহ্বানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শোষণ বঞ্চনা, নিপীড়িন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং বাঙালি জাতি বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রয়াসে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানি ভাবধারার স্বার্থান্বেষী কিছু লোকছাড়া, সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে এ স্বাধীন, স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের এ মহান মুক্তিযুদ্ধের, সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য যেমনি মহড়ার প্রয়োজন হয়, তেমনি এ মুক্তিযুদ্ধের জন্য দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ছিল। শুধুমাত্র একটি বেতার ঘোষণাকেই স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করে অনেকেই মিথ্যাচার করছে। দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। যে বেতার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এত বিতর্ক হচ্ছে, সে ঘোষণা প্রদানকালে যাঁরা বেতারে সংশ্লিষ্ট ছিলেন-তাঁরা ইতোমধ্যে লেখার মাধ্যমে, সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কিংবা বক্তৃতা দিয়ে প্রকৃত সত্য ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন-এটা সবার জানা। কিন্তু তারপরও একজন সৈনিকের ঘোষণার কথা প্রচার করে এক শ্রেণির পাকিস্তানপন্থিরা ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়।

১৯৭১ এর ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান চট্টগ্রাম শহরের বহাদ্দারহাটের পার্শ্বস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে প্রথম ২৬ তারিখ বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠকরেন। এ সময়তার সাথে উপস্থিত ছিলেন বোয়ালখালী হতে নির্বাচিত এমপি এমরহুম ডা. আবদুল মন্নান, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাশাহ-ই-জাহান চৌধুরী (পরবর্তীকালেএম.পি) ও ছাত্রনেতারাখাল চন্দ্র বণিক। বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়হতেএসে ২৭ মার্চ মেজরজিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি দ্বিতীয় বার বেতারে পাঠ করেন। ২৭ মার্চ মেজরজিয়া কর্তৃক পাঠকৃত ঘোষণাটি জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পরে আবার ২৮ মার্চ সংশোধিত আকারে মেজর জিয়া পুনরায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। অথচ এ ঘোষণা পাঠ নিয়ে দীর্ঘদিন অনাকাঙ্খিত বিতর্ক চালানো হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র হয়েছে।
জননেতা এম এ হান্নান কর্তৃক ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ দিবারাত্রির মত সত্য। ২৭ মার্চ মেজরজিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেছেন এটাও সত্য। মেজরজিয়া ২৮ মার্চ ঘোষণাটি পুনঃপাঠ করেন। অথচ দুর্ভাগ্য যে, লোকটির জন্ম না হলে আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারতাম না, যাঁর কারণে আমরা একটি স্বাধীন পতাকা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, সেখানে তারা মেজরজিয়ার ঘোষণা পাঠকে কেন্দ্র করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। এ কাজটি জাতির ইতিহাসে খুবই বেদনাদায়ক। অথচ জিয়া জীবদ্দশায় নিজেকে কখনও বঙ্গবন্ধুর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে মেজর জিয়া নিজেই যে সত্য তুলে ধরেছেন ইতিহাস বিকৃতিকারীরা সেই লেখাকেও অস্বীকার করছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকে কেন্দ্র করে জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর জায়গায় যখন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায় তাদের কাছে প্রশ্ন স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ কেন? স্বাধীনতা দিবস তো ২৭ মার্চ হওয়া উচিত। ইতিহাস বিকৃতিকারীরা এর সদুত্তর দিতে ব্যর্থ। এখন তারা নতুন ভাবে বলা শুরু করেছে, ২৬ মার্চ কালুঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজরজিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অথচ প্রকৃত সত্য ২৬ মার্চ ’৭১ জিয়া চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন না। তিনি বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী মেজর জিয়াকে শহরে আনার জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আমাকে নির্দেশ দেন। ২৬ মার্চ বিকেলে আমি, মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মানসহ বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে মেজরজিয়ার সাথে সাক্ষাৎকরি। ঐ দিন তিনি চট্টগ্রাম শহরে আসার অপারগতা জানিয়ে আমাদের ফিরিয়ে দেন। পরেরদিন ২৭ মার্চ তিনি চট্টগ্রাম শহরে আসেন এবং ২৭ ও ২৮ মার্চ তিনি কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এটিই হচ্ছে প্রকৃত তথ্য। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তারা যে বিতর্ক করছেন তা একেবারে অনাহুত।
মেজর জিয়ার ঘনিষ্ঠ একজন নেতা যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সাথে ছিলেন, চট্টগ্রামের এই নেতা কিছুদিন আগে একটি জনসভার বক্তৃতায় বলেছিলেন, মেজরজিয়া ২৭ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। যারা মেজর জিয়াকে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেন, তার কোন তথ্য, প্রমাণাদি কিংবা দলিল পত্র জাতির কাছে পেশ করতে পারবে না। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র যাঁরা চালু করেছেন, শব্দ সৈনিক যারা বেতারে তখন দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা অনেকেই এখনও জীবিত আছেন। তাঁরা বিভিন্ন গ্রন্থাদিও প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সকলে বলেছে এম এ হান্নান ২৬ মার্চ ও মেজরজিয়া ২৭, ২৮ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল অধ্যাপক আলী আহসান যিনি আয়ুব খান রচিত ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার’ বইয়ের অনুবাদ ‘প্রভু নয় বন্ধু’ অনুলিপি লিখেছেন। তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে এ সাক্ষাৎকারে ডাহা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছেন, ২৬ মার্চ ’৭১-এ জিয়ার ঘোষণা পাঠ তিনি নিজ কানে শুনেছেন বলে দাবি করেছেন। এসব জ্ঞান পাপীদের জন্য শুধু করুণাই হয়। আর একটি বিষয় অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি, বিএনপি জামাত সমর্থক তথা স্বাধীনতা বিরোধীরা দাবি করেন-মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনে নাকি দেশের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এদেশের ইতিহাস বিকৃতিকারীদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। ১৯৭০ সালে যখন ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাউন্সিলে যখন স্লোগান উঠেছিল তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা, ঢাকা। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। তখন এ দেশের ছাত্র-জনতা জিয়া নামের কাউকে চিনত না।
একাত্তর সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রটি ১০ কি. ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও স্টেশন ছিল। সীতাকু- ও দোহাজারীর পর তাআর শোনা যেতনা। ইতিহাস বিকৃতিকারীরা যখন বলেন জিয়ার ঘোষণায় দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাসম্পূর্ণ মিথ্যা। ১০ কিলো হাউসের চট্টগ্রাম রেডিওর ঘোষণা দেশবাসী শুনে নাই। তারা ইতিহাস বিকৃতির জন্য একথাগুলো বলেন।
পাকিস্তানি মদদপুষ্ট এ দেশীয় রাজাকার কুলাঙ্গারদের সাথে সুর মিলিয়ে বিএনপি বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতি করে কলুষিত করছে। নতুন প্রজন্মকে তারা বিভ্রান্ত করছে। তারা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ধারা পাল্টে দেবার চেষ্টায় লিপ্ত। শুধুমাত্র একটি ঘোষণাকে সামনে এনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করছে। এটা খুবই মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। মেজর জিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার। তার অবদানকে কোনভাবে অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাথে তারতুলনা করা অন্যায়। বঙ্গবন্ধু সকল বিতর্কের উর্ধ্বে, তিনি জাতির পিতা ও তিনি বাংলাদেশের স্থপতি। মিশরের নামের সাথে জামাল আবদুর নাসের, ইন্দোনেশিয়ার সাথে সুকর্নো, ভারতের নামের সাথে মহত্মা গান্ধীর নাম যেমন পৃথক করা যায় না, তেমনি বাংলাদেশের নামের সাথে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বিচ্ছিন্ন করা যাবেনা। আসুন আমরা সকল বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এ দেশকে বিশ্বের দরবারে একটি সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক দেশ রূপে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়েতুলি।

লেখক : জাতীয়সংসদ সদস্য ও সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট