চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা কপিগুলো বিলি করার সুযোগে আমি গর্বিত

লায়ন দিদারুল আলম চৌধুরী এমজেএফ 

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৫:১৩ অপরাহ্ণ

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু ভাষণের পর থেকেই ৭ কোটি মানুষের মত আমিও উজ্জীবিত হয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলাম বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। ২৫ মার্চের সেই দুঃসহ স্মৃতির দিনে সারাদিন আমার মামা মো. আবদুল কাদেরের সাথে সার্বক্ষণিক ফোনে যোগাযোগ রাখি। রাত প্রায় ১.৩০ মি. নাগাদ তার সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর জানতে পারি বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং আরও বলেন এটা কাউকে না জানানোর জন্য। এ খবর শুনলে বাঙাালিদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে।
২৬ মার্চ সকাল আনুমানিক ৬.৩০ মিনিটে মামা তার ফৌজদারহাট ওয়্যারলেস অফিসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে বলেন। দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়ে সেখানে পৌঁছে দেখতে পাই, তিনি একটি ম্যাসেজ কপি করছেন। মামার নির্দেশে আমিও সাদা কাগজ আর কাঠপেন্সিল দিয়ে

 

অনেকগুলি কপি করতে করতে বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বার্তাটি নিম্মরূপ:

MESSAGE TO THE PEOPLE OF BANGLADESH AND TO THE PEOPLE OF THE WORLD

Pakistan armed forces suddenly attacked the East Pakistan Rifles base of Peelkhana and Rajarbagh police camp in Dacca at zero hours on March 26, killing a number of unarmed people. I do hereby, declare independence. … May Allah bless you and help you in our struggle for freedom from the enemy.

Joy Bangla. Sheikh Mujibur Rahman – 26.3.71

মামা আমাকে দায়িত্ব দেন আমি যেন কপিগুলো কয়েকটি স্পটে পৌঁছে দিই। তার নির্দেশ মত ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে চট্টগ্রাম আসার পথে রাস্তার পশ্চিমপাশে ফকিরহাট পার হয়ে আবুল কাশেম মাস্টার (সাবেক সাংসদ) এর নিজ বাড়ির সংযোগ রোডের মাথায় তার ভাই পরিচয় দেওয়ায় তারই মাধ্যমে হস্তান্তর করি। হালিশহর কাঁচা রাস্তার মাথায় ই.পি.আর.-টাইগারপাসের নেভি রিক্রুটিং ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর সাথে গোলাগুলির তুমুল আকার ধারণ করায়, বারো কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশের গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে হালিশহর রোড ক্রস করে বেপারি পাড়ায় পৌঁছতেই স্টিল মিলের শ্রমিক নেতা বশরের দেখা পাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা বলি এবং তাকে ২/৩টি বার্তার কপি হস্তান্তর করি এবং তাঁর কর্মী বাহিনী দিয়ে পতেঙ্গা-স্টিল মিল-হালিশহরে ব্যাপক আকারে প্রচার করার অনুরোধ জানাই। তাঁর সাইকেল নিয়ে দ্রুত গতিতে তিনি প্রচারের উদ্দেশ্যে চলে যান। তারপর অতিদ্রুত গতিতে সরাসরি আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসের নুরুল হকের কাছে হস্তান্তর করি। যা এম এ হান্নানসহ অন্যান্য নেতাদের নির্দেশে তারা প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হন। শ্রমিক নেতা কাজী শামসুর রহমানের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, তিনি পাশের শ্রমিক লীগ অফিসে মিটিং করছেন। লোক মারফত শামসুর রহমানের কাছেও একটি কপি পাঠাই। ডা. নুরুন্নাহার জহুরের কাছে আমি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মেসেজটি পৌঁছে দিই। একজন পরিচিত ব্যক্তিকে ১ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে আখতারুজ্জমান বাবু ভাই এর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউসে পাঠাই। পথিমধ্যে শুনতে পাই নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে ৮ম বেঙ্গলের সিও কর্নেল জানজুয়াকে তার বাংলোতে বাঙালিরা ঘেরাও করে রেখেছে। এটি শুনে আমি নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ২নং সড়কস্থ পূর্ব পরিচিত ড্রাইডকের জি এম এম আই হোসেনের বাসায় সাইকেলটি রেখে সকলের সাথে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকি। তখন সময় প্রায় দুপুর ১টা। হঠাৎ পূর্ব দিক থেকে আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু হলে ২ ইঞ্চি দূরত্বে আমার পায়ের পাশ দিয়ে মাটি স্পর্শ করে গুলি চলে যায়। আমি ড্রেনের ভিতর দিয়ে ক্রোলিং করে ড্রাইডকের জি এম এর বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিই এবং রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকি। আনুমানিক দুপুর ২.৩০ টায় রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামের স্থলে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রাম নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। কয়েকজন কিছু কিছু বক্তব্য রাখার পর প্রথমে রাখাল চন্দ্র বণিক সঞ্চালকের ভূমিকায় বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এম এ হান্নান তা পাঠ করে শোনাবেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, আপনারা রেডিও বন্ধ করবেন না বলে কয়েকবার অনুরোধ করেন। আমাদের দেয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে হুবহু পাঠ করেন, যা আমি নিজ কানে শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবেগে কেঁদে ফেলি। পরের দিন তার একটি কপি থেকে মেজর জিয়া ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২য় বার স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি সংশোধিত আকারে পাঠ করেন। আজ আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি এ জন্য যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা কনফারমেশন কপিগুলি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ অফিস ও নেতৃবৃন্দকে হাতে হাতে বিলি করার সুযোগ পেয়েছি। এই কপি থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সিদ্ধান্তনুযায়ী হান্নান ভাই রেডিওতে পাঠ করে বৈধতা দিতে সক্ষম হওয়ায় নিজেকে অত্যন্ত গর্ববোধ করি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা পাঠ-প্রচার প্রক্রিয়ায় আমিও একজন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী ইতিহাসের অংশ হিসেবে এখনও বেঁচে আছি। সুতরাং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কেউ বিতর্ক করুক কোনমতে কাম্য বা গ্রহণযোগ্য নয়।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট