চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রত্যাশা

ডা. মাহফুজুর রহমান

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৪:০৪ অপরাহ্ণ

২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা ৫০ বছরে পা দিলো। হাজার বছরের বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম তার নিজস্ব বাসভূমি ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির ঘোষণা দেয়। অতপর সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন করে।

৪৭-৫২ ভাষা আন্দোলন, মূলনীতি রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন, ৫৪ সালের নির্বাচন, ৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর উক্তি, ‘সরকারি ভাষা বলতে আমরা কিছু বুঝি না, এই প্রস্তাব কুমতলবে দেয়া হচ্ছে, আমরা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চাই’ এবং এর প্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার বাস্তবায়ন ২০ বছর পিছিয়ে দেয়া, ৫৮ সালে সামরিক আইন জারি, ৫৯-৬০ সালে ছাত্র সমাজের হাত ধরে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সূচনা, ৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠন. ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা পেশ. শেখ মুজিব জেলে থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের এককভাবে ৭ জুনের সফল হরতাল পালন, ছাত্রসমাজের ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক বিজয়, মার্চের ১ তারিখে জনগণের স্বাধীনতা ঘোষণা, ২ তারিখ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা, ২৫ মার্চ পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সামরিক জান্তার গ্রেপ্তার করা, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, পরদিন তা চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত হওয়া, ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিপরীতে বাঙালি জনগণও সশস্ত্রবাহিনীতে থাকা বাঙালি সদস্যের প্রতিরোধ এবং অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন, মুষ্টিমেয় রাজাকার বদর ছাড়া সব বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়ার প্রেক্ষিতে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ, যুদ্ধে ৩০ লাখ লোকের আত্মাহুতি, ৫ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম যাওয়া সবই ইতিহাসের অংশ।

দীর্ঘ এই সংগ্রামের প্রাথমিক দিকে অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু বা সেই সময়ের শেখ মুজিব। চূড়ান্ত পর্যায়ে বলতে গেলে একক চালিকা শক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার অনুপস্থিতিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার নামে। প্রতিটি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্যের কথা বলেছেন। ৪৭ সাল থেকে চলা সব আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের নির্যাস প্রতিফলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ৭২ সংবিধানে।

প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণ অনুষ্ঠান আমরা করছি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন আমরা করছি কিন্তু বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৭২ সংবিধানের মুলনীতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে সব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তার কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি? যেমন ধরুন – সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে,‘ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। বাংলা ভাষার প্রচলনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর অনেক নির্দেশনা ছিল। ’৮৭ সালে বাংলা প্রচলনের জন্য আইনও হয়েছে। বর্তমান সরকারেরও অনেক নির্দেশ আছে এই ব্যাপারে। সরকারের দপ্তরগুলোতে বাংলার কিছুটা প্রচলন আছে তাও সর্বাংশে নয়। বেসরকারি খাতে বাংলার প্রচলন নেই।

 

’৮৭ সালের আইনে রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অহরহ আইন অমান্য করার দৃষ্টান্ত থাকলে শাস্তির কোন দৃষ্টান্ত নেই। বাংলাদেশের শহরগুলোতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজিতে লেখা নামফলক যা আইন ও আদালতের নির্দেশের প্রকাশ্য লঙ্ঘন। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ করা হয় বা নোটিশ দেয়া হয়, জরিমানা করা হয়। কিন্তু ইংরেজি নাম ফলকের প্রাধান্য কমে না। অথচ পুলিশ বা প্রশাসন ইচ্ছে করলে ২৪ ঘণ্টার ভিতর আইনের বিধি ও আদালতের নির্দেশ মানতে এদের বাধ্য করতে পারেন বা উচ্ছেদ করতে পারেন, টিভি চ্যানেলগুলোর ইংরেজি নামের পাশে বাংলা নাম লেখাতে বাধ্য করতে পারেন, টিভি চ্যানেলে ইংরেজি বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে বাধ্য করতে পারেন। এই সামান্য কাজটিও না করে বড় বড় অনুষ্ঠান করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোকে মেকি এক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কি বলা যায়?

পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলো তাদের মাতৃভাষায় সব ধরনের উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে বলেই জ্ঞান বিজ্ঞানে আমাদের চাইতে উন্নত হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাই উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুও এটা চেয়েছেন। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা প্রচলনের জন্য ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ‘অনুবাদ সংস্থা ’গঠন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র নায়করা এখন উচ্চ শিক্ষায় বাংলা প্রচলনের চিন্তা করেছেন এমন তথ্য নেই। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম স্বপ্ন -বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যেখানে এখনো অবহেলিত সেখানে কী করে বলবো বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে এগোচ্ছে?

সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। নির্ধারিত স্থর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের নির্দেশনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার সময়কালে বিনাবেতনে ৮ম শ্রেনি পর্যন্ত পড়াবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা এই নির্দেশনা মেনে এর পক্ষে যদি আইন পাস করাতেন তবে সেটাই হতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ সম্মাণ প্রদর্শনের একটি নিদর্শন।

সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’র কথা বলা আছে। বাংলাদেশে বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও দাঙ্গাসৃষ্টিকারী কোন লোককে চরম শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন তথ্য নেই। ‘মুজিব বর্ষে ’এসে যদি দাঙ্গাসৃষ্টিকারীদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতো তবে তা হতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার নিদর্শন। সংবিধানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আরো অনেক লক্ষ্য বর্ণিত রয়েছে যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য।

আমরা যারা জনগণ তারাও বিদেশি ভাষা সংষ্কৃতির চর্চায় পিছিয়ে নেই। আমাদেরও ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজন। বাঙালি সংষ্কৃতির বিকাশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সে কাজটি করা দরকার।

পরিশেষে বলা চলে সরকার এবং জনগণ মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে যেসব বড় বড় অনুষ্ঠান করছেন তার পাশাপাশি যদি ৭২ সংবিধানের বর্ণিত রাষ্ট্রের লক্ষ্যগুলো অর্জনে সচেষ্ট হন, লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে সচেষ্ট হন তবেই উন্নত যে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে তা হবে বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত, মুক্তিযুদ্ধের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ। এর কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

 

লেখক: ডা. মাহফুজুর রহমান। চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট