চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সমাচার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রকাশ

‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’

ইতিহাসের সাক্ষী মির্জা আবু মনসুর

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট ওয়ারলেসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠান। সে সময় আমি আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ অফিসে উপস্থিত ছিলাম। সেই বার্তায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যার যা আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার নির্দেশ দেন। এ মেসেজ পেয়ে আমি আমার চট্টেশ্বরী রোডের অফিসে এসে এবং আখতারুজ্জামান বাবু তার পাথরঘাটার বাসায় সাইক্লোস্টাইল মেশিন দিয়ে দুজনে রাতের মধ্যে অন্তত হাজার খানেক কপি করে ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম শহরের নিউ মার্কেট মোড়, আন্দরকিল্লাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে বিলির ব্যবস্থা করি। এ ঘোষণার কাগজ তখন কাজী ওহাব (রাউজান) কাজী সামসু (রাউজান) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখের মাধ্যমে আমরা এসব চট্টগ্রাম শহরে বিলি করি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা চট্টগ্রামের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ করার জন্য আমি আর মিরসরাইয়ের এমপিএ মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নিই। কিন্ত কোন পত্রিকাই তখন এ ঘোষণা প্রকাশের জন্য সাহস করেনি। একমাত্র মৃনাল চক্রবর্ত্তীর একটা পত্রিকা তখন “দৈনিক সমাচার” নামে হাজারী গলি থেকে প্রকাশিত হত। সেই মৃনাল চক্রবর্ত্তীই সাহস করে তার পত্রিকায় ছাপানোর দায়িত্ব নেন। ২৬মার্চ সকালে “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন” এ শিরোনামে সমাচার পত্রিকায় বঙ্গন্ধুর ঘোষণা প্রকাশিত হয়। কিন্ত এ ঘোষণা ছাপানোর পরদিন কি দুয়েক দিনের মধ্যেই পাক আর্মিরা সেই পত্রিকার অফিস গুঁড়িয়ে দেয়।

২৬মার্চ সকাল সাড়ে ৯টা ১০টার দিকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে আমি মোশাররফ হোসেন, আতাউর রহমান খান কায়সার, হাটহাজারীর এম এ ওহাব, আক্তারুজ্জামান বাবু, এম এ হান্নানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারে প্রচারের উদ্যোগ নিই। ২৬ মার্চ বেলা ১১টার দিকে কালুরঘাট বেতার থেকে এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি পড়ে শোনান এবং জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে বক্তব্য দেন। এরপর বেলা দেড়টা, ২টার দিকে আমরা নগরীর পাথরঘাটায় আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায় বৈঠকে বসি। সেখানে ইপিআর এর মেজর রফিক, মেজর শওকত, (আরেকজন ছিলেন তার নাম মনে নেই)।

২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর বাঙালি আর্মি, পুলিশ, ইপিআর সদস্য যারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিদ্রোহ করে বাহিনী থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তাদের একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধে সামিল করার লক্ষ্যে আমরা উপলব্ধি করি একজন সেনা সদস্যকে দিয়ে রেডিওতে একটা ঘোষণা দেওয়ানো দরকার। তখন বৈঠকে প্রস্তাব আসে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের নাম। কিন্ত তাকে পাওয়া না যাওয়ায় ইপিআরের মেজর রফিককে এ ঘোষণা দেবার জন্য আমি বলি। কিন্ত রফিক বলে-“আমার থেকে আরো সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রামে আছেন। তাদের মধ্যে কাউকে দিয়ে এ ঘোষণাটা করালে এটার গ্রহণযোগ্যতা আরো বহুগুণ বাড়বে। এরপর বিষয়টা মেজর শওকতকে বললে তিনি বলেন আমার থেকে সিনিয়র মেজর জিয়াউর রহমান বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে ষোলশহর ২নং গেটের (বর্তমান বিপ্লব উদ্যান) কাছে টিসিবি গোডাউনের সামনে আছেন। ২৬ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ আমি আমার ফোক্সওয়াগন খ-৬০০ নাম্বারের গাড়িটা নিয়ে সেখানে গিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে খুঁজতে থাকি। এসময় সেখানে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুইয়া ও ক্যাপ্টেন এনামের সাথে দেখা হলে তারা আমাকে কালো চশমা পরা মেজর জিয়ার কাছ নিয়ে যান। আমি বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পর তিনি প্রথমে আমার প্রস্তাব শুনে থ’হয়ে যান। পরে কয়েকজন অফিসারের সাথে কথা বলে যেতে রাজি হন। অতপর আমি পুনরায় আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে সেখান থেকে আমি আর মোশাররফ হোসেন আবার কালুরঘাট বেতারে গিয়ে টেকনেশিয়ানদের সংগঠিত করি। সেখানে সেকান্দার হায়াৎ খান, তার ভাই হারুন খান, বেতারে প্রকৌশলী ফজলে এলাহী, অনুষ্ঠান প্রযোজক বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ প্রমুখ বেতার চালুর জন্য সাহায্য করেন। অতপর রাত সাড়ে ৭টা (২৬মার্চ) নাগাদ মেজর জিয়া এসে ঘোষণা করেন-“ আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি”।

জিয়ার এ ঘোষণা শুনে আমরা নিজেরাই স্তম্ভিত হয়ে যাই। জিয়ার এ ঘোষণা দেশে বহির্বিশ্বে ভুল তথ্য ছড়াবে। যেমন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু। এখন যদি এক সেনা সদস্যের মুখে এই ঘোষণা হয় তাহলে দেশ বিদেশে মানুষের কাছে বাঙালিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব হলো কিনা এরকম সন্দেহ তৈরি হবে। এটা জিয়াকে বলার পর তিনি বলেন, “আমি একজন সৈনিক, আমি বক্তব্যের অত মারপ্যাঁচ বুঝি না। কী বলতে হবে আপনারা লিখে দেন”। তখন আমি আর মোশাররফ জহুর আহমদ চৌধুরী আর এমআর সিদ্দিকীকে খুঁজতে সেখান থেকে ফিরে আসি। কিন্তু ততক্ষণে তারা রামগড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। তখন নেতাদের কথায় আমরা দুজন আমার গাড়ি নিয়ে তাদের খুঁজতে ফটিকছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।

আমরা রাউজান হয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফটিকছড়ি পৌঁছে আব্দুল বারী চৌধুরীর বাড়িতে যাই। আমরা সেখানে যাবার ঘণ্টা দুয়েক আগে জহুর আহমদ চৌধুরী আর এম আর সিদ্দিকী রামগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন বলে শুনি। কিন্তু সেখানে আমরা একে খান এবং তাঁর ছেলে জহির উদ্দিন খানকে পাই। একে খানকে বিষয়টি বলার পর তিনিও বলেন যে জিয়ার এ ঘোষণা বিভ্রন্তি ছড়াচ্ছে। অতপর আমাদের অনুরোধে একে খান সাহেব নিজে একটি ঘোষণা লিখে দেন। সেই ঘোষণাটি ছিল নিন্মরূপ

“I major Ziaur Rahman on behalf of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman do hereby declare the independence of Bangladesh.” all arms forces including E.B.R, E.P.R, police, ansars VDP, are requested to join in liberation struggle and join in kalurghat bridge as early as possible to fight for liberation of Bangladesh”

এই ঘোষণার লেখক ছিলেন একে খান। বাহক ছিলাম আমি আর মোশাররফ এবং পাঠক ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই ঘোষণা নিয়ে আমরা দুজন পরদিন ২৭ মার্চ সকাল ৮টা নাগাদ পুনরায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে আসি। এবং সেদিনই (২৭মার্চ) বেলা ১১টায় মেজর জিয়া সে ঘোষণা পুনরায় পাঠ করেন। এরপর সেদিন ৫ মিনিট পরপর আরো কয়েক দফায় এ ঘোষণা প্রচার করা হয়। সে সময় ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন সুবদ আলী ভুঁইয়া, ক্যাপ্টেন হারুন, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান প্রমুখ তার সাথে ছিলেন। এ ঘোষণার পর বেলা ১২টা নাগাদ জিয়া আমাদের উক্ত বেতার কেন্দ্র ত্যাগ করে কালুরঘাট সেতুর দক্ষিণ তীরে সরে যেতে নির্দেশ দেন। আমরা সেখান থেকে সরে যাবার কিছুক্ষণ পর পাক বাহিনী উক্ত বেতার কেন্দ্রের উপর কয়েক দফা সেলিং করে। সেদিন রাতে বিদ্রোহী সেনা, পুলিশ, ইপিআর সদস্যদের জরো করে এবং যানবাহন সংগ্রহ করে মেজর শওকত ও মেজর রফিকের নেতৃত্বে তাঁদের সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহর হানাদার মুক্ত করতে পাঠাই। কিন্ত তারা চকবাজারের পর আর অগ্রসর হতে না পেরে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে খবর আসে মেজর জিয়া কাউকে কিছু না জানিয়ে বোয়ালখালী থানার করলডেঙ্গা পাহাড় হয়ে কক্সবাজার চলে গেছেন। এসময় মেজর রফিক মুক্তিবাহিনীর জন্য সহসা অস্ত্র ও গোলাবারুদের একটা চাহিদাপত্র আমাকে দেন। সেই তালিকা নিয়ে আমি ২৮মার্চ চট্টগ্রাম থেকে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমি রামগড় গিয়ে সেখান থেকে সহযোদ্ধাদের পরামর্শক্রমে আমার ছোট ভাই মির্জা মোহাম্মদ বাবর, নুরুল আলম চৌধুরী (সাবেক এমপি) হারুণ খান প্রমুখকে কালুরঘাট বেতারের ট্রান্সমিটারটি নিয়ে আসার দায়িত্ব দিই। তারা সফলতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করে। ২৯মার্চ আগরতলা পৌঁছে আমি ৯১বিএসএফ অধিনায়কের সাথে দেখা করে মেজর রফিকের দেওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের চাহিদা পত্রটি হস্তান্তর করি। তার নিকট জেনেছি জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমআর সিদ্দিকী আগরতলা অবস্থান করছেন। তাদের সাথে যুক্ত হয়ে ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের মাধ্যমে তৎকালীন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহের সাথে দেখা করি। বিষয়টি তাঁকে বলার পর তিনি এটা কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচ্য বিষয় উল্লেখ করে আমাদের তিন দিন অপেক্ষা করতে বলেন। অতপর আমি সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে অবস্থান করি। সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য সে সময় আমাদের অনেক নেতা, শরণার্থী মুক্তিযোদ্ধাকে অকাতরে সহযোগিতা করেছিলেন। তিন দিন পর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ২ এপ্রিল আমাকে ১০/১২ বক্স অস্ত্র ও গোলা বারুদ বিএসএফ এর মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। সে সব অস্ত্র নিয়ে আমি আর সহযোদ্ধা ইদ্রিস আলম পুনরায় ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে এসে ফটিকছড়ির নারায়নহাটে এসে হস্তান্তর করি। সেখানে জানতে পারি মেজর জিয়া আমার অপর ছোট ভাই মির্জা মোহাম্মদ আকবরকে ও আমার চাচা আখতার মিয়াকে সাথে নিয়ে রামগড়ের দিকে গেছেন।

আমি নারায়নহাট থেকে রামগড় ফিরে গিয়ে রামগড়ের তৎকালীন এসডিও ও রামগড় থানার ওসি মান্নানের সহযোগিতায় সেখানে আসা বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, হাজার হাজার শরণার্থী প্রমুখের থাকার ব্যবস্থা করি। সেখানে প্রতিদিন আসা হাজার হাজার শরণার্থী আর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসা হাজার হাজার মানুষের জন্য শরণার্থী ক্যাম্প খুলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি আর মোশাররফ হোসেন নিরন্তর কাজ করি। এক পর্যায়ে সেখানে আমাদের সাথে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, এসডিও এম এ সামাদ, এসডিও রকিব উদ্দিন আহমদ, ডা.ক্যাপ্টেন সামসুল হকসহ বিভিন্ন ব্যক্তি আমাদের সাথে যোগ দেন। ২ মে হানাদার বাহিনীর হাতে রামগড়ের পতন হলে আমরা ভারতের সাব্রুমে চলে যাই।

অতপর আমরা হরিনায় একটি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করি। সেখানে ট্রেনিং শেষে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে আমরা ১৪ জন এম পি এ ও এম এন এ কে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের জন্য বিহারের চাকুলিয়া সেনা প্রশিক্ষণ কলেজে পাঠানো হয়। সেখানে কয়েক দফা প্রশিক্ষণ শেষে আমি, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ, ডা.এম এ মান্নানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত মেজর হিসেবে কমিশন দিয়ে অগ্রবর্তী এলাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাকে ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের অধীনে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ,রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টর “জোনাল কমান্ডারের” দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতপর আমি বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি ও পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করি। সে সময় পাক হানাদার বাহিনী আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল এক লক্ষ টাকা। মুক্তিযুদ্ধে আমি “মালেক সাহেব” নামে ছদ্মনাম ধারণ করে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করি।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মির্জা আবু মনসুর ফটিকছড়ির নানুপুর ইউপির এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মির্জা আবু আহম্মদ সারা পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ছিলেন। মির্জা আবু মনসুর ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের হয়ে চট্টগ্রাম কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। ’৭০ এর নির্বাচনে তিনি ফটিকছড়ি থেকে অতি অল্প বয়সে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মুসলিম লীগ প্রার্থী আব্দুস সালামকে পরাজিত করে এমপিএ নির্বাচিত হন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট