চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সীতাকু-ে ইয়ার্ড নির্মাণে ভূমি ইজারা

সাগরপাড়ের জায়গা নিয়েদুই সংস্থার টানাটানিা

বন বিভাগের মামলা া পরিবেশের সুরক্ষার জন্য বেলার চিঠিা পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিস

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সীতাকু-ের উত্তর সলিমপুরে উপকূলীয় এলাকায় শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের জন্য ইজারা দেওয়া ভূমি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন সরকারি খাস জায়গা হিসেবে বিবিসি স্টিল নামে একটি শিপব্রেকিং ওয়ার্ডকে সাগর তীরের জায়গা ইজারা দেয়। উপকূলীয় বন লাগোয়া জায়গা বন বিভাগের বলে দাবি করে আসছে বন বিভাগ। এই নিয়ে সরকারি দুটি সংস্থা বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঘন বন ঘেরা এই জায়গা ইয়ার্ডের জন্য ইজারা দেওয়ায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করেছেন পরিবেশবিদরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সীতাকু-ের সলিমপুরে বিবিসি স্টিলকে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য ৭ দশমিক ১০ একর উপকূলীয় জায়গা ইজারা দেন। ইজারা নিয়ে বনের ভেতরে রাস্তা নির্মাণ করে শিপব্রেকিংয়ের কাজ শুরু করেছে ইজারাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে প্রচুর গাছ কাটা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দা ও বন বিভাগের। এই অভিযোগে ইয়ার্ড মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বন বিভাগ। এছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কায় লিজ বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে আইনি নোটিস দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. গোলাম মাওলা পূর্বকোণকে বলেন, ‘জায়গাটি আমাদের (বন বিভাগের)। ১৯৮৩-৮৪ সালে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়েছে। এখনো ১০-১৫ হাজার গাছের ঘন বাগান রয়েছে। এ ধরনের ঘন বনের মধ্যে জায়গা লিজ দেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জেলা প্রশাসন কোনভাবে তা লিজ দিতে পারেন না।’
ইজারা দেওয়া জায়গা জেলা প্রশাসন নামে খাস খতিয়ানের বলে দাবি করেছেন জেলা প্রশাসন। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘জায়গাটি ১নং খাস খতিয়ানের। বনবিভাগের জায়গা নেয়। বনবিভাগ গেজেট দেখাতে পারেনি। জায়গা দাবি করলে তো হবে না, গেজেট থাকতে হবে। মন্ত্রণালয়ের গেজেট হলে সংরক্ষিত বনে পরিণত হয়। তখন ইজারা দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আমরা যেটা দিয়েছি সেটা ১নং খাস খতিয়ানের। এখানে কোন বন নেই।’ তবে ইজারা দেওয়া জায়গা বনবিভাগ গাছ রয়েছে বলে দেখাতে পারলে ইজারা বাতিল বা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বন বিভাগের জায়গা না হলেও শিপব্রেকিং নির্মাণে গাছ কাটার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গাছ কাটা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগ রয়েছে, কেওড়া বনের ভেতরে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই প্রচুর গাছ কাটা হয়েছে। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে বিবিসি স্টিলের মালিক আবুল কাসেমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বন বিভাগ। পরিবেশ অধিদপ্তরও নোটিস দিয়েছে। এছাড়া প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও বন রক্ষায় লিজ বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে আইনি নোটিস দিয়েছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। বেলার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ কবীর এই নোটিস দিয়েছেন। ইয়ার্ড মালিকের বিরুদ্ধে সরকারি দুটি সংস্থার মামলা ও বেলার আইনি নোটিস উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মালিকপক্ষ।
উপকূলীয় বন বিভাগের দাবি, ১৯৮৩-৮৪ সালে সীতাকু-ের উত্তর সলিমপুর মৌজায় বন বিভাগ ৪শ একর জায়গায় ম্যানগ্রোভ বাগান গড়ে তোলে। বর্তমানে ১৫-২০ হাজার গাছের ঘন বন রয়েছে। ওই জায়গার ৭ দশমিক ১০ একর বনভূমি সমুদ্র সিকস্তি ভূমি দেখিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর বিবিসি স্টিলের মালিক মো. কাশেম রাজা প্রকাশ এমএ কাসেম রাজা প্রকাশ রাজা কাসেমকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ভূমি অফিস জালিয়াতি করে বনের জায়গা খাস খতিয়ান হিসেবে নিজের নামে করে নিয়েছে।
ঘন বন এলাকায় শিপব্রেকিং ওয়ার্ডের জন্য লিজ দেওয়া জমির লিজ বাতিলের জন্য বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি ল্যান্ডসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (উপকূলীয়) মো. গোলাম মাওলা পূর্বকোণকে বলেন, সরকারি ম্যানগ্রোভ বাগানের মধ্যে শিপইয়ার্ড নির্মাণের জন্য লিজ দেওয়ার বিধান নেই। এখানে ইয়ার্ড নির্মাণ করতে গিয়ে কয়েক হাজার গাছ কাটা পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘লিজে শুভঙ্ককরের ফাঁকি আছে। কোন জায়গা লিজ দিয়েছে তা চিহ্নিত করেনি। বনের মধ্যে একটি লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে তারা। আমি সে পতাকা ফেলে দিয়েছি।’
উপকূলীয় বন বিভাগের কাট্টলী সদর রেঞ্জের বিট অফিসার মো. আবু তৈয়ব বাদী হয়ে গত ২ এপ্রিল বিবিসি স্টিলের মালিক মো. আবুল কাশেম (রাজা) ও বিবিসি স্টিল ম্যানেজার মো. হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, সীতাকু-ের ফৌজদারহাট ঝুনা মার্কেট এলাকায় উত্তর সলিমপুর মৌজায় বেড়িবাঁধের নিচ থেকে শুরু করে পুরো বনভূমি লোহার জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ চলছে। বনের ভেতরে রাস্তা তৈরি করে ট্রাকযোগে মাটি ফেলা ও মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ চলছে।
এলাকাবাসী জানায়, ইতিপূর্বে ওই জায়গায় শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য পাঁয়তারা হয়েছিল। স্থানীয় সাংসদ সাংসদ দিদারুল আলম এই বিষয়ে আপত্তিপত্র দিয়েছিল। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ইয়ার্ড নির্মাণের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
পরিবেশগত ছাড়পত্র না নিয়ে ইয়ার্ড নির্মাণের অভিয়োগে বিবিসি স্টিল মিলকে নোটিস দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মোয়াজ্জম হোসাইন। আগামী ৬ মে ইয়ার্ড মালিকপক্ষকে শুনানির জন্য হাজির হওয়ার জন্য নোটিস দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় এই বিষয়ে পূর্বকোণকে বলেন, ‘বিএস রেকর্ডমূলে ৭ দশমিক ১০ একর জায়গা আমরা লিজ দিয়েছি। এর বাইরে কিছু করা হলে তার দায়-দায়িত্ব ইজারাগ্রহিতার।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা লিজ দিলেও আবুল কাসেম সেখানে রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। নিয়ম বহির্ভূত কিছু হলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বিবিসি স্টিল শিপব্রেকিং লিমিটেডের মালিক মো. আবুল কাসেম এই বিষয়ে বলেন, ‘এক বছর ধরে আমাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এখানে বনবিভাগে কিছুই নেই। ডিসির নামে গেজেট রয়েছে। লিজ নিয়ে ইয়ার্ড নির্মাণ করছি।’ তিনি দাবি করেন, এখানে ৩৫ একর জায়গা থাকলে বন রয়েছে মাত্র দুই একর জায়গা। বাকি জায়গা খালি ও বালুচর।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট