চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পুরো প্রক্রিয়ায় চরম অনিয়ম

রেলের খালাসি নিয়োগ হ নিয়োগ পেয়েছে ৫০ বছরবয়সী বৃদ্ধ , কোন কোটাই মানা হয়নি হ একাধিক জায়গা থেকে নিয়োগ একইব্যক্তি, একই পরিবারের দু’জনের

ইমাম হোসাইন রাজু

২৪ জুন, ২০১৯ | ২:২৪ পূর্বাহ্ণ

মো. ইউসুফ রায়হান। পিতা আবু বকর সিদ্দিক। বর্তমানে চাকরি করছেন রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীতে। তার ভাগ্য এতই ভাল যে, এবার খালাসিতে তার নাম এসেছে। তাও আবার দুই জেলা থেকে। একবার ঢাকা (২ নম্বর সিরিয়াল) জেলা থেকে আরেকবার জামালপুর (৩৪৪ নম্বর সিরিয়াল) জেলা থেকে। তার আপন ভাই আবিদ ইসলাম। ২০১৬ সালে ১৬ জুলাইয়ে রেলওয়ের বাবুর্চি পদে চট্টগ্রাম জেলা কোটায় চাকরি করছেন। কিন্তু সম্প্রতি ৮৬৩ খালাসি পদেও তার চাকরি হয়েছে। তাও টাঙ্গাইল জেলা থেকে। ফলাফল তালিকায় আবিদ ইসলাম রয়েছেন ২৮৮ নম্বরে।
শুধু ইউসুফ রায়হান বা আবিদ ইসলামেই নয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দীর্ঘ ছয় বছর পর নিয়োগ পাওয়া ৮৬৩ জন খালাসি পদে নিয়োগের নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি, আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়োগের ফলাফল দেখলে যে কেউই সহজে এসব অনিয়ম বুঝতে সক্ষম হবেন।
অর্থের বিনিময়ে এক ব্যক্তিকে একাধিক জায়গা থেকে নিয়োগ, কোটা না মানা, বয়স্ক ব্যক্তিদের চাকরি দেয়াসহ নানান অসঙ্গতি উঠে এসেছে এ অনুসন্ধানে। এছাড়াও এ নিয়োগ কমিটির বোর্ডকে নিয়েও রয়েছে একাধিক অভিযোগ। বেশিরভাগ তথ্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এ কমিটির সদস্যরা গাড়ি চালক, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার, পিয়ন এবং দালালদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেছেন। তাছাড়া ফলাফল কপিতে নিয়োগ কমিটির অনুস্বাক্ষরে সিলমোহর থাকার কথা থাকলেও তা নেই। তবে কীভাবে এ নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হলো এমন প্রশ্ন নিয়োগবঞ্চিত ও সংশ্লিষ্টদের।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি চাকরি পেয়েছেন একাধিক জেলা থেকে। আবার একই পরিবারের আপন দুই ভাই চাকরি পেয়েছেন; যাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ দিনের। এরমধ্যে মো. সোহরাব হোসেন ও তার ভাই ফরহাদ হোসেন। তাদের প্রকৃত বাড়ি কুমিল্লায়। তবে খালাসি পদে নারায়ণগঞ্জ জেলা কোটায় চাকরি হয় দু’জনের। সোহরাব হোসেন ও ফরহাদ হোসেন দুই জনেই শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন বলে খালাসি নিয়োগের সময় সার্টিফিকেট জমা দেন। ওই সার্টিফিকেট যাচাইকালে দেখা যায়, সোহরাব হোসেন ও তার ভাই ফরহাদ হোসেনের বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ দিনের। সেখানে সোহরাব হোসেনের জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ১২ মে ১৯৮৭ সাল। আর ফরহাদ হোসেনেরও একই বছরের ৭ মে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও তাদের মেঝো ভাই বর্তমানে ওয়েম্যান পদে কুমিল্লাতে চাকরি করছেন। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে জন্ম, তাও আবার একই পরিবারে দুই জনের চাকরি এমন জালিয়াতির পরও কেন নিয়োগ কমিটির চোখে ধরা পড়েনি- এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।
শুধু তারাই নয়। নিয়োগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এমন ঘটনা আরও ঘটেছে। তাদের মধ্যে মো. আব্দুল হান্নান ও মো. মমতাজর রহমান। দুইজনই আপন ভাই। তাদেরও চাকরি হয়েছে খালাসি পদে। বিধি অনুযায়ী একই পরিবারের মাত্র একজন নিয়োগ পাওয়া কথা থাকলেও দুইজনেই নওগাঁ জেলা থেকে চাকরি পেয়েছেন।
মো. মোজাম্মেল হক। তিনিও নিয়োগ পেয়েছেন খালাসি পদে। তাও আবার দুই জেলা থেকে। ফলাফলে দেখা যায় একবার ৪৪০ নম্বর সিরিয়ালে কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে আবার ৮২২ নম্বর সিরিয়ালে খাগড়াছড়ি কোটায় তার চাকরি হয়েছে। ৩৮২ নম্বর সিরিয়ালে নাম রয়েছে মো. আরিফ হোসেনের। কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখা যায়, আরিফ হোসেন বর্তমানে রেলওয়ের গেট কিপার পদে রাজশাহীতে কর্মরত রয়েছেন। এরপরও এ খালাসি নিয়োগে এসেছে তার নাম। আরিফ হোসেন একা নয়। এ নিয়োগে তার আপন বোন আয়েশা সিদ্দিকা রাত্রিও নিয়োগ পেয়েছেন ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে। তার সিরিয়াল নম্বর হচ্ছে-৮৫৭। শুধু এ ক’জনই নয়। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই ব্যাপক অনিয়মের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে ৫০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে ২৮ বছর বয়সের সার্টিফিকেট দিয়েও এ নিয়োগে চাকরি পেয়েছেন এমন তথ্যও উঠে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম’র গাড়ি চালক হারাধনের আপন খালু সুকুমার দে। সুকুমারের বর্তমান বয়স ৫০ বছর হলেও নিয়োগ নেওয়ার সময় বয়স দেখিয়েছেন ২৮ বছর। অথচ তাঁর ছেলের বয়সই হচ্ছে ১৮ বছর। চাকরি পাওয়া এই সুকুমার নিজ ভাগিনাকে ঘুষ দেওয়া থেকে রেহাই পাননি। এ চাকরি পেতে সুকুমার হারাধনকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন প্রতিবেদকের কাছে।
জানতে চাইলে সুকুমার দে বলেন, ‘আমার ভাগিনার (জিএম’র গাড়ি চালক হারাধন) মাধ্যমে চাকরি হয়েছে। এ চাকরি পাওয়ার জন্য তাকে (হারাধনকে) ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি’। তবে সার্টিফিকেট ও কাগজপত্র কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সব কাজ হারাধন করেছে। সে কীভাবে কি করেছে তা জানিনা। শুধু বলেছে টাকা দিলে সব কিছুই পাওয়া যাবে’।
এসব বিষয় অস্বীকার করে জিএম’র ড্রাইভার হারাধন পূর্বকোণকে বলেন, ‘সুকুমার নামে কাউকে আমি চিনি না। এ নামে আমার কোন খালু বা আত্মীয় নেই। যে বলেছে তা মিথ্য তথ্য দিয়েছে। আমি একজন সাধারণ ড্রাইভার। নিয়োগ নিয়ে আমি কেন এমন কাজ করবো’।
শুধু হারাধনই নয়। অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, রেলওয়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি চালক, পিয়ন, কর্মচারী, ঠিকাদার ও দালালদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন নিয়োগ কমিটির সদস্যরা। কমিটির সদস্যরা এসব অর্থ সরাসরি নিজেরা লেনদেন না করলেও গাড়ি চালক, পিয়ন, কর্মচারীদের দিয়ে লেনদেন করেছেন। এবং অর্থের বিনিময়ে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিয়েছেন নিয়োগ কমিটি। যার কারণে এ নিয়োগে যে ধরণের কোটা মানার কথা ছিল, তার কোনটাই মানা হয়নি। রেলের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী মোট জনবলের ১০ ভাগ চাকরি দিতে হবে প্রতিবন্ধী অথবা এতিমদের। সে হিসেবে ৮৬৩ জনের মধ্যে ৮৬ জন এতিম বা প্রতিবন্ধী থাকার কথা। কিন্তু ফলাফল দেখে বুঝার উপায় নেই, কে এতিম আর কে প্রতিবন্ধী। বাকি ৯০ ভাগের ৪০ ভাগ দিতে হবে পোষ্যদের। সে হিসেবে ৩১০ জন পোষ্য চাকরি পাওয়ার কথা। এ পোষ্যদের নিয়েও রয়েছে নানান অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে শ্রমিক নেতা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘এক পোষ্যের তিন থেকে চার জায়গায় নিয়োগ হয়েছে। অন্যজনের এক জায়গাতেও হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে ভাগ্যের জোরে। এটা কি ধরণের ভাগ্য। কষ্টি পাথরে ঘষে ঘষে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে অসঙ্গতি ছিল তা যে কেউই দেখলে বুঝতে পারবে। ফরম পূরণের সময় কোটা উল্লেখের বিষয়টি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ফলাফলে কাকে কোন কোটা থেকে নির্বাচন করা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি কেন? তাহলে আপনার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আর ফলাফলতো সাংঘর্ষিক। এ নিয়োগ কখনোই সুষ্ঠু হয়নি’।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল ১৪০ জনের। তবে কারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তাও ফলাফল দেখে বোঝার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, উপজাতি কোটায় সারাদেশে ২৩ জন নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও একজন উপজাতিরও জায়গা হয়নি এ নিয়োগে। বিশ্লেষণ করলে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে আরও নানা অসঙ্গতি। তবে এসব অসঙ্গতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করছেন স্বয়ং দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৪ জুলাইয়ে ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। এতে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের নাম দিয়ে দুই বছর পর সে নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানকে। সদস্য সচিব ছিলেন আরটিএ’র সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার জোবেদা আক্তার। সদস্য হিসেবে রাখা হয় রেলওয়ের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, এম এ জিন্নাহ ও শেখ খলিলুর রহমানকে। তবে এ কমিটির সদস্য এম এ জিন্নাহ মারা যান এবং শেখ খলিলুর রহমান অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হন।
নিয়োগ বিধি অনুযায়ী এই দুইজনের পরিবর্তে অন্য দুইজনকে সংযুক্ত করার কথা থাকলেও তা না করে নিয়োগ কমিটির বাকি তিনজন মিলে তড়িঘড়ি করে বন্ধের দিন ফলাফল ঘোষণা করেন। আবার ফলাফল ঘোষণার তিন ঘণ্টার মাথায় নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান দেশের বাইরে চলে যান। নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করা হলেও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সৈয়দ ফারুক আহমদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বচ্ছতার সাথে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। যদিও এসব বিষয়ে জানতে সৈয়দ ফারুক আহমদের অফিসে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাঁর অফিস থেকে ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জনসংযোগ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, তিনি আগামী ১ জুলাই পর্যন্ত ছুটিতে রয়েছেন। এরপরও জিএম’র মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সবশেষে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের কাছে এসব বিষয় জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখনোতো নিয়োগ হয়নি। ফলাফলে যদি কোন অসঙ্গতি থেকে থাকে, তাহলে তা বাতিল করা হবে’।
একই ব্যক্তি একাধিক জেলা থেকে নিয়োগ পাওয়া এবং একই পরিবারের দুইজন নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি হয়তো ভুলেই হয়েছে। তবে একই পরিবারের দুইজন তা কিভাবে খুঁজে বের করবো। কাগজে যা লিখা ছিল তা দেখেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে’। বয়স্ক লোক কিভাবে নিয়োগ পেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজে বয়স দেখে আমরা নির্বাচন করেছি। তবুও বিষয়টি আবার দেখবো।
কোটা মানা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শতাভাগ কোটা মেনেই এ ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে’। অর্থ লেনদেনের বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে পূর্বকোণকে বলেন, ‘এ ধরণের বিষয় সম্পূর্ণ মিথ্যে ও বানোয়াট। এমন কোন তথ্যই সঠিক নয়। আমরা যোগ্যতা অনুসারে ফলাফল ঘোষাণা করেছি। এখনে কোন অর্থ লেনদেনের মতো ঘটনাই ঘটেনি’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট