চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কামারুজ্জামানের চিঠির পথে চলছে সংস্কারপন্থী জামায়াত !

নাজিম মুহাম্মদ

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের চিঠি অনুসরণ করে হাঁটছে সংস্কারপন্থী জামায়াত। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের এ নেতাকে আদালতের আদেশে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের সহ-সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জমানকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে জামায়াত ইসলামী যে সব নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে তাঁদের দলীয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭নং সেল (বকুল) থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে জামায়াত ইসলামীর ৬০ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রামের বিশ্লেষণ করে দলের জন্য বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রস্তাব করেন।
নতুন সংগঠনের রূপরেখা সম্পর্কে চিঠিতে কামারুজ্জামান বলেছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভা কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। বিশিষ্ট নাগরিক, প্রবীণ আলেম ও প-িত ব্যক্তিদের নিয়ে দলের একটি অভিভাবক পরিষদ থাকবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবে না। সব পদের ব্যবহার বাংলা পরিভাষায় হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক ও ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে। সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে ‘জনআকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের আত্মপ্রকাশ হয়েছে গত শনিবার। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীতে বিভক্তির অভিযোগ এনে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় মঞ্জুকে।
শিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে প্রতিশ্রুত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে জাতীয় জীবনের সব অর্জন ও ঐক্যের জায়গাগুলো সমন্বিত করে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি প্রস্তুত করা প্রয়োজন। প্রচলিত কোনও রাজনৈতিক ধারা বা দলের অনুসারী কিংবা অনুরক্ত নয়, এটা সম্পূর্ণ স্বাধীন উদ্যোগের একটি স্বতন্ত্র ধারা। জামায়াতে ইসলামীসহ বিদ্যমান কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক দল হবে সত্যিকার অর্থে ইনক্লুসিভ এবং একটি ইতিবাচক বাংলাদেশ গড়ার নতুন রাজনৈতিক কার্যক্রম এটি।’
কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে না উল্লেখ করে মঞ্জুু বলেন, ‘আমাদের অনুপ্রেরণার উৎসস্থল ইসলামের উদার ঐতিহ্য ও সাম্যের দর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উল্লেখিত মূলনীতি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ আমাদের জাতীয় ঐক্যের পাঠাতন।’ একাত্তরে যে আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছিলো বাংলাদেশ, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেওয়ার দায়িত্ব বোধ করছি আমরা।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মেজর (অব.) আবদুল ওহাব মিনার, এডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জুবায়ের আহমেদ ভুঁইয়া, মাওলানা আবদুল কাদের, মাওলানা তাজুল ইসলাম, গোলাম ফারুক গৌতম দাস, ড. কামাল উদ্দিন প্রমুখ। তবে মঞ্চে না থাকলেও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর নাম ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন নেতা জানান, মুজিবুর রহমান মঞ্জুু আমাদেরই লোক। তিনি একটি দল দাঁড় করাতে পারলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা দোয়া করি তিনি যেন সফল হন। জামায়াত কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মঞ্জুর নতুন দল গঠনের বিষয়ে কোন বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করবেনা। বরং নিরবতাই পালন করবে।
কামারুজ্জামান লিখেছিলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করার মতো অতি স্পর্শকাতর কোনো অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহনযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে।
প্রায় ছয় হাজার শব্দের এই চিঠিতে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘খুব নাজুক’ এবং জামায়াতের জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন কামারুজ্জামান। তিনি সেই চিঠিতে দলকে টিকিয়ে রাখতে তিনটি পরামর্শও দিয়েছিলেন।
তা হলো- যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব। (এ কৌশল বর্তমানে অবলম্বন করা হয়েছে)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এ সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবেলা করবে এবং আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবে। সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো। যেটি হবে ‘নিউ জেনারেশনের জামায়াত।’
কামারুজ্জামান লিখেছিলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।
কারাগারে আটক নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে চিঠির এক জায়গায় কামারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি আরো লিখেছিলেন, আমাদের অনেকের তো বয়সও হয়েছে। সরাসরি আন্দোলনে থাকলেই বা আমরা আর কতটা অবদান রাখতে পারব? সুতরাং সবাই মিলে দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি, তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাঙ্খিত এবং যুক্তিযুক্ত। তিনি উল্লেখ করেন, এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাঁর মতে, জামায়াতের নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুণœ হবে। দেশের ভেতরে-বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। জামায়াতের ভাব-মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জামায়াতকে পেছন থেকে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে নতুন প্লাটফর্মে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন কামারুজ্জামান। তাঁর মতে, সেই প্লাটফর্মের রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুঁকি গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আমরা মিটমাট করতে পারিনি অথবা এই রাজনৈতিক বিরোধটি নিরসন করতে পারিনি, আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম এটা একসময় এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, আমাদের অনেকের চিন্তার গন্ডি অতিক্রম করে এটা একটা জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, সরকারও এ বিষয়ে অবশ্যই একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর এবং কিছু না হলেও দল ও নেতৃত্বের ভাবমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে এবং জনমনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে। সামগ্রীক বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি। আমরা যদি নতুন কর্মকৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট