চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

এ বর্ষায়ও ভোগাবে চাক্তাই খাল

৮ আষাঢ়েও যে চিত্র উৎকন্ঠায় নগরবাসী

ইফতেখারুল ইসলাম হ

২৩ জুন, ২০১৯ | ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

হ খালের গভীরতা কোথাও
মাত্র দেড় থেকে দুই ফুট
হ স্বাভাবিক বৃষ্টি হলেও
দুর্ভোগের আশঙ্কা
হ কোথাও খাল থেকে মাটি
তোলার চিহ্ন দেখা যায়নি

বহদ্দারহাট হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত চাক্তাই খালের গভীরতা কোথাও দেড় থেকে দুই ফুট কোথাও তিন থেকে চার ফুট। খালের কোন কোন অংশে পলি পড়ে ঘাস এবং লতা গুল্ম জন্মে গেছে। আর কোথাও পলিথিনে ঢাকা পড়েছে পুরো খাল। নগরীর বৃহৎ একটি অংশের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম এই খালটির বর্তমান চিত্র দেখে এলাকাবাসীর আশঙ্কা অন্যান্য বছরের মত এবার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। ইতিমধ্যে অনেকেই বর্ষার প্রস্তুতি হিসেবে বাড়ির সামনে পাকা দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের পেছন থেকে চাক্তাই খালের শুরু হিসেবে গণ্য করা হয়। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে মুখের ১০০ গজ দূরে যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে খালের একাংশ ভরাট করে বাঁধের সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর খালটি যতই এগিয়েছে গভীরতা তত কমেছে। শুরুর দিকে প্রায় ১০ ফুট গভীরতা থাকলেও কিছুদূর গিয়ে চার ফুটে নেমে এসেছে। আরেকটু এগিয়ে জঙ্গিশাহ শাহী আবাসিক এলাকা সংলগ্ন খালে গভীরতা দেখা গেল এক থেকে দেড় ফুট। শাহী আবাসিক এলাকার মুখে পুরাতন ব্রিজ ভেঙে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পুরাতন ব্রিজের পিলারগুলি রয়ে গেছে। তাতে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ওইসব পিলারের সাথে পলি আটকে বাঁধের সৃষ্টি হচ্ছে। বাদুরতলা হারেছ শাহ ব্রিজটিও নির্মাণ করা হয়েছে স্বাভাবিক লেভেলের চেয়ে অন্তত ১০ ফুট উপরে। সেখানেও পুরাতন ব্রিজের পিলারের অংশ তোলা হয়নি। বাদুরতলা শাহী আবাসিক এলাকা, হারেছ শাহ আবাসিক এলাকা, ঘাষিয়া পাড়াসহ আশপাশের আবাসিক এলাকাসমূহ ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি ভবনে সামনে পাকা দেয়াল দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বছরের তিন মাস এসব এলাকার নিচতলা বসবাসের অযোগ্য থাকে। অনেক ভাড়াটিয়া অন্যত্র চলে যায়। যারা থাকে তারাও কষ্টের মধ্যে যাতায়াত করে। বিশেষ করে শিশু বয়স্করা বাসা থেকে বের হতে পারে না। যারা বের হতে বাধ্য হন তারা নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হন। খুব বেশি জরুরি কাজ না থাকলে বর্ষাকালে এসব এলাকার মানুষ ঘর থেকে বের হয় না।
চাক্তাই খালে পলিথিনের দেখা মিলেছে চকবাজার ফুলতলা এলাকা থেকে। ৮০’র দশকে অর্থাৎ এরশাদের আমলে চাক্তাই খালের পানি দ্রুত নামার জন্য ধুনিরপুল এলাকায় একটি ডাইভারশন খাল নির্মাণ করা হয়। খালটি বাকলিয়া দিয়ে গিয়ে মূল চাক্তাই খালের সাথে মিশেছে। এছাড়া এখানে মূল চাক্তাই খালের সাথে আরো দুইটি খাল এসে মিশেছে। কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা এবং আশপাশের পানি একটি খাল দিয়ে এসে ধুনিরপুল এলাকায় চাক্তাই খালের সাথে মিশেছে। আরেকটি এসেছে চন্দনপুরার দিক থেকে। তাই এখানে পানির চাপ একটু বেশি। ধুনিরপুলের যে অংশ থেকে ডাইভারশন খাল শুরু হয়েছে সেই ব্রিজের নিচে রয়েছে সেবা সংস্থার পাইপ। ধুনিরপুল থেকে কয়েক’শ ফুট সবুজবাগ আবাসিক এলাকা আল কুরআন ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা সংলগ্ন যে লোহার ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে তার আগে একটি পুরাতন ব্রিজ ছিল। সেই পুরাতন ব্রিজের পিলারগুলি খালের মাঝে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সব আবর্জনা আটকে এক ধরনের বাঁধ তৈরি হয়েছে। গজিয়েছে লম্বা লম্বা ঘাস। বাকলিয়া মিয়ার বাপের মসজিদের আগে মাদ্রাসা হযরত মুয়াজ বিন জবল (রজি.) সংলগ্ন এলাকায় অর্থাৎ ব্রিজের আগে খালের মধ্যে ঘাস লতাগুল্মে জন্মেছে। একসময় চাক্তাই এলাকায় চাক্তাই খাল শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। বড় বড় নৌকা, সাম্পান এবং বিভিন্ন ধরনের জলযানে দিনরাত পণ্য উঠানামা করত। কিন্ত এখন সেই কোলাহল তেমন নেই। হাতে গোনা কিছু ছোট নৌকায় মালামাল উঠানামা করা হয়। মিয়াখান নগর হয়ে চাক্তাই খাল যেখানে কর্ণফুলীর সাথে মিশেছে কোথাও খাল থেকে মাটি তোলার চিহ্ন দেখা যায়নি। নিয়মিত জোয়ার-ভাটার কারণে যতটুকু পরিষ্কার হয় ততটুকুই আছে। খালের মুখে একাংশে বড় একটি বাঁধ দেখা গেছে। মিয়াখান নগর জহির সওদাগর কলোনির বাসিন্দা উজ্জ্বল বিশ^াস জানান, এবার খাল থেকে এক বালতি মাটিও তোলা হয়নি। গতবার কোমড় সমান পানি হয়েছিল। এবার হয়তো তার চেয়ে বেশি হবে।
বক্সিরহাট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. জামাল হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালের দিকে চাক্তাই খালের চার কিলোমিটার অংশের তলা পাকা করেন তৎকালীন মেয়র আলহাজ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। খালের তলা পাকা করার পর থেকেই বহদ্দারহাট এবং আশপাশের বেশ কিছু অংশে জলাবদ্ধতা হতে শুরু করে। মূলত খালের তলা পাকাকরণ ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চাক্তাই খালের উপর যেসব ব্রিজ নির্মাণ করেছে তা মানুষের বাসা বাড়ির লেভেল থেকে অন্তত ১০ ফুট উঁচুতে। তাতেই বোঝা যায় তখন প্রকৌশলীরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের রাজস্বের টাকা পানিতে ফেলেছিল। একদিকে অর্থের অপচয় অপরদিকে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি। ওই উদ্যোগের কারণে নগরবাসী দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, তখন খালের গভীরতা ১০ ফুট ধরে তলা পাকা করা হয়েছিল। সেই পাকা তলাও এরপর থেকে আর কেউ দেখেনি। কারণ খালটি কখনোই ভালভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।
ঘাসিয়া পাড়া মহল্লা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাসের পূর্বকোণকে বলেন, বিশেষত পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, চকবাজার থানাধীন কাপাসগোলা, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, চকবাজার, ডিসি রোড, বাড়াইপাড়া, ঘাসিয়া পাড়া, পশ্চিম বাকলিয়ার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই খাল। আর চাক্তাই খালের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য আশির দশকে চকবাজার ধুনির পুল হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ডাইভারশন খাল খনন করা হয়। বর্তমানে নগরীর জলবদ্ধতার নিরসনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ পাওয়ার পর পুরো একটি শুষ্ক মৌসুম চলে গেছে। চাক্তাই খাল থেকে এখনো কোন মাটি অপসারণ করা হয়নি।
বিশেষত চাক্তাই খালের ডাইভারশন অংশের অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এলাকাবাসী বলেন, প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাইভারশন খাল হতে এই মৌসুমে এক বালতি মাটিও তোলা হয়নি। বর্তমানে খালটি ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম চলে গেলেও চাক্তাই খালের মূল অংশে (বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত ) কর্তৃপক্ষ এখনো খনন কাজ করেনি তবে সম্প্রতি রাতের বেলা কখে জায়গায় খনন কাজ করলেও কাজের গতি ছিল অত্যন্ত ধীর এবং দায়সারা। এই শহরের মানুষের অন্যতম প্রধান সমস্যা বর্ষায় জলবদ্ধতা সমস্যা হলেও গুরুত্ব বিবেচনায় চাক্তাই খাল খনন নিয়ে যে ধরনের কর্মযজ্ঞ থাকা দরকার তার ছিটেফোঁটাও নেই। সিডিএ এর সাবেক চেয়ারম্যান পতেঙ্গার পর্যটন প্রকল্প দ্রুত সমাপ্ত করার জন্য যেভাবে রাতদিন প্রকল্প এলাকায় পড়েছিলেন, একইভাবে যদি জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করতেন তাহলে চট্টগ্রামবাসী অনেক উপকৃত হতেন। তাদের অভিযোগ সরকার জলবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব চসিক হতে নিয়ে সিডিএ’কে দিয়ে দেয়ার কারণে চসিক এখনো এব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। আগে দিনের বেলা পরিষ্কার করলেও এখন তারা তা রাতে করে। গভীর রাতে লোকজনের অনুপস্থিতির সুযোগে তারা দায়সারাগোছের কাজ করে চলে যায়। বস্তুত বর্ষায় এই শহরে কত ঘনফুট পানি জমে এবং তা ধারণ করার জন্য চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদী হতে কত ঘনফুট মাটি প্রতিবছর অপসারণ বা খনন করতে হবে তার বাস্তবসম্মত কোন সমীক্ষা তথা গবেষণা রিপোর্ট সিডিএ বা সিটি কর্পোরেশনের নেই। তাই তাদের পরিকল্পিত কোন কার্যক্রমও নেই। ফলে তাদের তথাকথিত অপরিকল্পিত খনন কাজের সুফল জনগণ পাচ্ছে না।
মেগা প্রকল্পের সিডিএ’র পক্ষ থেকে নিয়োজিত পরিচালক প্রকৌশলী আহমেদ মঈনুদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। চাক্তাই খালেও তাদের কাজ চলমান আছে উল্লেখ করে বলেন, এবার অন্যান্যবারের তুলনায় নাগরিক দুর্ভোগ অনেক কম হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট