চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

দেশে করোনার এক বছর: মুক্তিযুদ্ধই আমাদের চাঙ্গা করে তুলেছিল

ডা. শাকিল আহমেদ 

৮ মার্চ, ২০২১ | ৬:১৫ অপরাহ্ণ

করোনার মহামারীর একবছর অতিবাহিত হয়েছে। এই পুরো সময়টা একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। যে দিনগুলোর কথা এখনও মনে পড়লে শিউরে উঠি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম চীনে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, ঠিক তখনই এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুতি শুরু করতে থাকি। যেহেতু বিআইডিআইডিতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব আছে, তাই এ ব্যাপারে ফ্রান্সের একটি ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দেই। দিন গড়াতে যখনই ভয়ংকর হচ্ছে, তখন নমুনা টেস্টের বিষয়ে সকল সহযোগিতা করতে আশ্বস্ত করে ফাউন্ডেশনটি। যদিও ওই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস বিশ্ববিদ্যালয় (বিআইটিআইডি) ল্যাবে পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। একমাত্র দেশের আইডিসিআর-ই এ কাজটি করতেন। তখন চীন থেকে ফেরত এ অঞ্চলের ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের লক্ষণ দেখা দিলে এখানেই নমুনা সংগ্রহ করে তা আইডিসিআর এ পাঠাতে হতো। যদিও পরবর্তীতে ফাউন্ডেশন মেরি টেস্টের কিট এবং রি-এজেন্ট সাপ্লাই দিলে এ ব্যাপারে সরকারকে অবহিত করা হয়। অনুমতি আসার পরদিনগুলোই যেন আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

২৪ মার্চ ২০২০ থেকে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা শুরু হয় এখানে। যেখানে শুধু চট্টগ্রাম জেলাই নয়, পুরো বিভাগের নমুনাগুলো পরীক্ষা করার দায়িত্বও কাঁধে নেয়া হয়। প্রথমদিকে টেস্টের বড় সমস্যা ছিল করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্মীদের ভীতি কাটানো। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও ছিল। একই সাথে নমুনা পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে সক্ষম করে তোলা। পুরো বিষয়টিই তখন চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম স্যাম্পল যখন কালেকশন করা হয়, তখন সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে খুবই ভীতি কাজ করেছিল। প্রথম স্যাম্পল কালেকশনের সময় নিজেই উপস্থিত ছিলাম। ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ওই দিনের কথা মনে পড়লো এখনও শিউরে উঠি। কর্মীদের মধ্যেও ছিল জল্পনা। কিন্তু পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা। তাদের সাথে প্রতিদিনই বসে একটা জিনিসকে সামনে হাজির করতাম। তাহলো ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’।

বলেছিলাম, ১৯৭১ সালে কিছু সৌভাগ্যবান সাহসী ব্যক্তিরা যুদ্ধ করেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এখন আমরা যতই আন্তরিক হই না কেন, যতই চেষ্টা করি না কেন, স্বাধীনতার সৈনিক হওয়া সম্ভব নয়। করোনার এ মহামারী আমাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা এ সময় একইভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ-দেশের মানুষ এবং জাতিমানবতার জন্য একটা বিশাল কাজ করতে পারবে। বলেছিলাম, ঘর-বাড়িতে লুকিয়ে থাকলেও করোনা হতে পারে।

 

তাই বীরের মতো সামনে থেকে করোনার সাথে লড়াই করে মরে যাওয়াও বীরত্বের। এসব কথায় সবাই উৎজীবিত হয়। এমনও দিন ছিল সারা শহর অন্ধকার, এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ছুটে গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে। কর্মীদের ভয় কাটাতে নিজেই তাদের সঙ্গী হতাম।

ধারণা ছিল করোনা অল্প সময়ের জন্য আসেনি। তাই প্রথম থেকেই জোর ছিল আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। টেস্টের পরিমাণ বাড়িয়ে তা সারা দেশেই ছড়িয়ে দিতে হবে। ডিজি অফিসের সহযোগিতায় সমস্ত উপজেলার ল্যাব টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। যাতে তারা নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠাতে পারে। কিন্তু নমুনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় সিভাসু, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তাদের নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে উদ্বত্ত করি। তারাও এ যুদ্ধে সামিল হয়। সবাই মিলেই আজ করোনা মোকাবেলায় এগিয়ে যাই।

খুবই কষ্ট ছিল, আমাদের ল্যাবে যে জনবল তা শুধুমাত্র ৮ ঘণ্টা কাজ করার মতো। কিন্তু আমরা টানা ১৮ ঘণ্টাও কাজ করেছি। এমনও দিন গিয়েছে দুপুরের খাবারের যোগানও পেতে কষ্ট ছিল। শুধুমাত্র বিস্কুট, চা কলা খেয়েই দিন কাটিয়েছে সহকর্মীরা। প্রতিদিন ভোরে ল্যাবে ঢুকলে বাসায় যেতে হতো রাত ১২ থেকে ১টায়। সকল মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও ল্যাব টেকনিশিয়ানদেরও মনবল দিয়ে এ কাজে যুক্ত করতে পেরেছি। যে কারণে চট্টগ্রাম বিভাগে মাত্র একটা ল্যাব থেকে বর্তমানে প্রায় ১৭টা ল্যাব সৃষ্টি হয়েছে।

দুই মাসের মাথায় আমি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হই। কিন্তু একটুও আমি ভীত হইনি। প্রথম দিন থেকেই মনবল শক্ত করে এবং করোনাকে সামনে থেকে মোকাবেলা করার ইচ্ছে পোষণ করে কাজ শুরু করেছিলাম। তাই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও সেদিন রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্তও কাজ করেছি। নিজের রিপোর্টে নিজে স্বাক্ষর করে তারপর বাসায় ফিরেছি।। সুস্থ হওয়ার পরদিনেই কাজ শুরু করে দেই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও ল্যাব প্রধান আরটিপিসিআর, বিআইটিআইডি।

 

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট