চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা চিকিৎসার রোল মডেল ফিল্ড হাসপাতাল

ইফতেখারুল ইসলাম 

৮ মার্চ, ২০২১ | ২:১৯ অপরাহ্ণ

সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসকরা যখন দিশেহারা তখনই ফিল্ড হাসপাতালের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করে দেশে করোনা চিকিৎসার রোল মডেলে পরিণত হয়েছে ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। যেখানে সেবা নিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬শ’ রোগী। তবে রোগীর সংখ্যার চেয়েও কোন কমিউনিটি সেন্টার কিংবা খোলা স্থানেও উদ্যোগ নিয়ে করোনার চিকিৎসা সেবা দেয়ার ধারণা তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। শহর এবং মফস্বলে গড়ে উঠেছে করোনা আইসোলেশন সেন্টার এবং হাসপাতাল।

জানতে চাইলে ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ও সিইও ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া পূর্বকোণকে বলেন, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব শুরু হওয়ার পর সরকারি স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। চারিদিকে মানুষের আতঙ্ক আর চিকিৎসা সেবা পাওয়ার যে হাহাকার তা নির্বাক করে দিয়েছিল সবাইকে। এর পরের গল্পটা সবার জানা, চট্টগ্রামে একটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। সুইডেনে থাকার সময় এ রকম বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলাম। ২৫ মার্চ ফেসবুকে প্রথম পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করি। খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করে ৩০ মার্চ নাভানা গ্রুপের পক্ষ থেকে কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

ফৌজদারহাট সংলগ্ন সিটি গেট এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের ষোল হাজার বর্গফুটের দোতলা একটি উন্মুক্ত শেড দিতে রাজি হলেন তাঁরা। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করলাম না। কিন্তু হাসপাতাল তৈরি আর চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের অর্থ আসবে কোত্থেকে? এবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘এক লাখ লোক এক’শ টাকা করে দিলে এক কোটি টাকার তহবিল গঠন হবে।’ এক লাখ জনের সাড়া না মিললেও, অনেকেই এগিয়ে এলেন। ১ এপ্রিল ফেসবুকে তহবিল গঠনের কথা বলেছিলাম আর ২১ এপ্রিল ৫০ শয্যা নিয়ে শুরু হয়ে গেল ফিল্ড হাসপাতালের কাজ। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিলেন ৩ জন চিকিৎসক। পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা। স্বেচ্ছাসেবক হতে ইচ্ছুক এ রকম তরুণদের আবেদন করতে বলা হয়েছিল। সাত শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয়েছে ২১ জনকে। এই স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য বিশেষ শর্ত ছিল প্রত্যেককেই পিতা-মাতার স্বাক্ষর করা অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে, যেখানে উল্লেখ থাকবে মৃত্যুঝুঁকির কথাও।

তিনি জানান, ‘প্রথমে আমি নিজেই জমা দিয়েছি অঙ্গীকারনামা, কিন্তু এতগুলো তরুণ ও তাঁদের পিতা-মাতার অঙ্গীকারনামা হাতে পেয়ে আমি সত্যি বিস্মিত! আমার মনোবল সেদিনই বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ।’ পেশাদার নার্সদের সঙ্গে এই স্বেচ্ছাসেবীরা দিনরাত কাজ করেছে। সব মিলিয়ে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা হাসপাতালটি করোনাকালে হয়েছিল বিশেষায়িত উদ্যোগে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন দেশের সর্ব প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল। আন্তরিকতা ও ভালবাসা দিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করলে যে রোগীরা দ্রুতই সুস্থ হয় তা পরিলক্ষিত হতো রোগীদের অশ্রুসিক্ত বিদায়ে। চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর হতে সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটা হয় ফিল্ড হাসপাতালে অনুসরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইসোলেশন সেন্টার ও অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করা। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কমতে থাকে সংক্রামণ। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যখেতে সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং সঠিক পদক্ষেপে বাংলাদেশে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেই সংক্রামণ ১% নিচে নেমে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার কারণে ভ্যাক্সিনেশন নীতিমালার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ এখন ভ্যাক্সিনের অন্তর্ভুক্ত।

করোনার এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছি। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশে হাজারো প্রিয়মুখ-প্রিয় মানুষের বিদায় আমাদের করেছে স্বজনহারা। সৃষ্টিকর্তা এক অদৃশ্য ভাইরাসের মাধ্যমের আমাদের প্রকৃতির শক্তি সম্পর্কে ধারণার দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে ‘হে বিশ্ববাসী ধ্বংস, হানাহানি বন্ধ করে ফিরে আসো শান্তি আর সম্প্রীতির পথে।’ জানিয়ে দিয়েছেন তিনিই সব সময়ের সবকিছুর একমাত্র পরাক্রমশালী।

আর প্রাপ্তি হিসেবে প্রকৃতি মানুষ চিনিয়ে দেয়ার চরম সত্যতা আমাদের জন্য এক মহৎ শিক্ষা। পরনির্ভরশীলতাকে পরিত্যাগ করে স্বয়ং পরিপূর্ণ হওয়ারও শিক্ষা দিয়ে গেছে মহামরী এই করোনা। করোনা পৃথিবী হতে একবারে বিলুপ্ত হবেনা, বাকি রোগগুলোর মতোই রয়ে যাবে আমাদের সাথে। শুধু ২০২০ করোনা রয়ে যাবে স্মুতি, বেদনাময় আর শিক্ষার ভা-ার হয়ে।

আলাপকালে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, একটি সাধারণ ভাইরাস আমাদের সবার জীবনকে একেবারে থমকে দিয়েছে। আমরা এর আগেও এরকম ভাইরাসের হুমকিতে পড়েছি। মহামারিরও মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন সংক্রমণ বা মৌসুমী ফ্লুর জন্য এর আগে কখনো বিশ্বে সবকিছু এভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি।

করোনা মুক্তি আইসোলেশন সেন্টার : করোনার কারণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয় প্রচারণার প্রায় শেষের দিকে। প্রচারকাজের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে তারুণ্যের দিনগুলো ও ৭১ এর প্রেরণা নিয়ে সংগ্রামী পথচলাকে পুঁজি করে মাঠে রয়ে গেলেন। ভোট চাওয়ার কাজ বাদ দিয়ে করোনাযুদ্ধে নেমে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। বিতরণ করেন স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। তাদের পাশে দাঁড়ান খাবার নিয়ে। করোনার প্রকোপ বাড়ার পর যখন সরকারি হাসপাতাল সেবা দিয়ে কুল পাচ্ছে না। অপরদিকে, বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে তখনই বাকলিয়া কালামিয়া বাজার এলাকায় নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠান করেন ‘করোনা মুক্তি আইসোলেশন’ সেন্টার ও বিনামূল্যে আউটডোর চিকিৎসা কেন্দ্র। করোনাকালে ২৯৮ জন করোনাক্রান্ত বা করোনা সন্দেহে আসা রোগী সেবা পেয়েছেন এই সেন্টারে।

করোনা আইসোলেশন সেন্টার চট্টগ্রাম : সেন্টারের মূখপাত্র এডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেন, তারা ৮০০ রোগীর সেবা দিয়েছেন। মৃত্যুর হার ছিল শূন্য। ওষুধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা সব বিনামূল্যে করা হয়েছে। ১২ জন চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নাস ছিলেন ১০ জন। এছাড়া ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক ছিল। ২০২০ সালের ১৩ জুন চালু হওয়া এই সেন্টার বন্ধ হয় একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর। এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা সব রোগীকে খাবার থেকে শুরু করে সব ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। তিনি জানান, এই সেন্টারের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন, তৌহিদ, ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমানসহ কয়েকজন। সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রণি। প্রথমে শুধু আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে চালু করা হলেও পরবর্তীতে চিকিৎসা সেবা চালু করা হয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম দিয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ, একজন দানশীল ব্যক্তি হাইফ্লো নজল ক্যানুলা দিয়েছিলেন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। যে যার সাধ্যমত সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রিন্স অব চিটাগাং সম্পূর্ণ ফ্রিতে দিয়েছিলেন ওই কমিউনিটি সেন্টারের মালিক। দৈনিক ২০ হাজার টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল খরচ হত। বন্ধের দিনসহ মোট খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০ লাখ টাকা। তারপরেও প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ বাকি ছিল। পরে তাও পরিশোধ করা হয়।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আইসোলেশন সেন্টার : এই সেন্টারের সার্ভিস ডিরেক্টর ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, চারদিকে যখন আতংক। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে করোনা রোগীর সেবা চালু করতে গিয়েও পারল না। ওইসময়ের মেয়রের সাহসী পদক্ষেপে এই সেন্টার চালু হয়। তখন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকরা কাজ করেছেন। করোনার চিকিৎসা তখন আর বর্তমান সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। অনেকটা অন্ধকারের মধ্যেই চিকিৎসকরা সেসময় কাজ শুরু করেছিলেন। ওইসময় অনেক চিকিৎসক দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করেছিল। কেউ কেউ চাকুরিও ছেড়েছিলেন। তবে তিনি সেবার দায়িত্ব পালনে না বলতে পারেননি উল্লেখ করে বলেন, এই ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে এখনো বেঁচে আছেন। এটাই প্রাপ্তি। এই সেন্টারে ১২৫ জন রোগী সেবা নিয়েছিল। এছাড়া আউটডোরে সেবা নিয়েছে প্রায় ৩০ জন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে আইসোলেশন সেন্টার করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে সিটি কনভেনশন হলটি দিয়েছিল সীকম গ্রুপ। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বিনা ভাড়ায় এটি ব্যবহারের জন্য দেন।

সিএমপি-বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসাপাতাল : পতেঙ্গার বি কে কনভেনশন হলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ও স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলে ১০০ শয্যার করোনা হাসপাতাল। যার নামকরণ করা হয় ‘সিএমপি-বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসপাতাল।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট